
বান্দরবানঃ আগামী ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ ধাপে দেশের ৮৪৮টি ইউপিতে ভোট হবে। দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ১৭ অক্টোবর, মনোনয়নপত্র বাছাই ২০ অক্টোবর, বাছাইয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল ২১ থেকে ২৩ অক্টোবর, আপিল নিষ্পত্তি ২৪ ও ২৫ অক্টোবর, প্রার্থিতা প্রত্যাহার ২৬ অক্টোবর, প্রতীক বরাদ্দ ২৭ অক্টোবর এবং ভোট গ্রহণ ১১ নভেম্বর। আর ২য় ধাপের এই ইউপি নির্বাচনে বর্তমান চেয়ারম্যানদের বিগত দিনের কার্যক্রম নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের এই পর্বে থাকছে বান্দরবান পার্বত্য জেলার লামা উপজেলার রূপসী পাড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছাচিং প্রু মারমার কার্যক্রম নিয়ে।
সাধারণ এক স্কুল শিক্ষক থেকে পর পর দুই বারের ইউপি চেয়ারম্যান ছাচিং প্রু মারমা। দুই বারের চেয়ারম্যান থাকার ফলে এলাকার উন্নয়ন অগ্রগতি এবং তার কার্যক্রমে ব্যপক প্রশংসিত হবার বদলে হয়েছেন সমালোচিত। এহেন কুকর্ম নেই যা করেননি এই চেয়ারম্যান। জনপ্রতিনিধি হয়ে নিজেকে জনগণের ত্রাসে পরিণত করেছেন। একাধিক নারী কেলেংকারী, ধর্ষণ, রোহিঙ্গাদের ভোটার বানানো ও জাল জাতীয় সনদপত্র প্রদান, ভূয়া জন্মনিবন্ধন বাণিজ্য, বিনামূল্যের জন্মনিবন্ধন সনদে নিয়েছেন ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা, সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প ও ভূমি অধিগ্রহণের নামে অর্থ আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি, ষড়যন্ত্র মামলা এমনকি মুজিববর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের বহুল আলোচিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে অনিয়ম এবং এমনকি টাকা ছাড়া একজনও পাননি এই ঘর।
আরও পড়ুনঃ বান্দরবানের লামাসহ তিন উপজেলার উপহারের ঘরে অনিয়ম
১০ বছরে গড়েছেন অঢেল সম্পদের মালিকঃ লামা উপজেলার মং প্রু মারমার ছেলে রূপসী পাড়া ইউনিয়নের দুই বারের চেয়ারম্যান ছাচিং প্রু মারমা। লামা মংপ্রু পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের চাকুরী ছেড়ে ২০১১ সালে রূপসী পাড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে ইউনিয়নকে পরিণত করেছেন দুর্নীতির আখড়ায়। ২০১১ সালের পূর্বে সম্পদ বিবরণী মতে ১ একর জমি, স্ত্রীর ৫/৬ ভরি স্বর্ণ ও সামান্য নগদ টাকা ছাড়া কিছুই ছিলনা। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে সম্পদ বিবরণীর তথ্য মতে তার স্ত্রীর চাকুরীর বেতন, চেয়ারম্যান ভাতা, জমি লাগিয়ত বাবদ বাৎসরিক আয় উল্লেখ করা হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। কিন্তু পাঁচ বছরে তার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে কয়েকশ গুন। লামার রূপসী পাড়া ইউনিয়নে প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তুলেছেন ডুপ্লেক্স অট্টালিকা। নামে বেনামে দখলে নিয়েছে শত শত একর বনভূমি।

দুর্নীতির সাধারণ খতিয়ানঃ লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্তি ও রোহিঙ্গাদের জন্ম সনদ প্রদান, মং প্রু পাড়া হতে রূপসী পাড়া পর্যন্ত সড়ক নির্মাণে জমি অধিগ্রহণের আসল মালিকদের নাম বাদ দিয়ে তার পরিবার ও নিকট জনদের ভূয়া মালিক সাজিয়ে নামে অর্থ আত্মসাৎ, অসহায় মানুষের বাগানের গাছ লুটপাট, সরকারী বিধি লঙ্ঘন করে ইউনিয়নের ৬টি বাজার ইজারা, ভিজিডি কার্ড বিতরণে অর্থ আদায়, অন্যের আইডি ব্যবহার করে ভিজিডি রেশন তুলে বিক্রি, হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় করে নামমাত্র সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে বিশাল অংকের অর্থ আত্মসাৎ, মুজিববর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের বহুল আলোচিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে অনিয়ম এবং টাকা ছাড়া একজনকেউ দেওয়া হয়নি এই উপহারের ঘর, সরকারি পরিদর্শনকালে তথ্য গোপনসহ বিভিন্ন অপকর্মের তথ্য পাওয়া গেছে ।২০১৭ সালে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের ফি ৭৫ ভাগ কমিয়ে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে জন্মের ৪৫ দিন পর্যন্ত নিবন্ধন ফি মওকুফ করা হয়েছে। ৪৫ দিন থেকে ৫ বছর পর্যন্ত জন্ম নিবন্ধন ফি ২৫ টাকা, ৫ বছরের পর ১০ বছর পর্যন্ত জন্ম নিবন্ধন ফি ৫০ টাকা এবং ১০ বছরের পর নিবন্ধনের কোন সুযোগ রাখা হয়নি। তবে সংশোধন ফি একইভাবে কমানো হলেও এখানে নিবন্ধন ফি’র চেয়ে পরিস্থিতি ও প্রয়োজন অনুসারে সংশোধন ফি ৩/১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে । বিশেষ করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে সংশোধিত নিবন্ধন ইস্যুতে বেশি পরিমাণ অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে বলে জানা গেছে। এভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুনঃ লামার রূপসীপাড়া ইউনিয়নে চলছে রমরমা জন্মসনদ বাণিজ্য!
একাধিক নারী কেলেঙ্কারিঃ বিভিন্ন সময় স্থানীয় বাঙ্গালীদের যৌন হেনস্থার অভিযোগ থাকলেও সম্প্রতি সাহায্য প্রার্থী এক পয়ত্রিশোর্ধ অসহায় নারীকে ফোনে কুপ্রস্তাবের অডিও ক্লিপস ভাইরাল হয়েছে। পরবর্তীতে ওই নারীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে বান্দরবান জেলা আদালতে একটি মামলাও করেছেন ভোক্তভুগী নারী (মামলা নং- সি আর ১৯/২০২১)। মামলাটির তদন্ত ভার সিআইডি’র হাতে রয়েছে। ওই নারীর অভিযোগ, ছাচিং প্রু মারমা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে ও অর্থের বিনিময়ে মামলার তদন্তকে ভিন্নখাতে প্রভাবিত করার মিশনে নেমেছেন।
কর ও রাজস্ব ফাঁকিঃ চেয়ারম্যান থাকাকালীন এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসন কর্তৃক ইউনিয়ন পরিষদের কর্মকান্ড পরিদর্শন হয়েছে মোট ৪বার। ইউনিয়নে নাইখ্যং মুখ বাজার, রূপসী পাড়া বাজার, রূপনগর বাজার, অংলা পাড়া বাজার, শীলের থোয়া বাজারসহ মোট ৬টি বাজার রয়েছে। অতচ পরিদর্শন রিপোর্টে কোন বাজার নেই এবং এসব বাজার থেকে কোন রাজস্ব আদায়ের তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাজার ইজারা বাবদ ৩৬ লাখ টাকা আদায় হলেও সরকারী কোষাগারে যায়নি এক পয়সাও। এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদে ৩টি মৌজায় ৬৫টি গ্রামে ৩ হাজার ২৫০টি বাড়ি রয়েছে। প্রতিটি বাড়ি থেকে সর্বনিম্ন ১৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০০০ টাকা পর্যন্ত কর আদায় করা হয়। প্রতি বছর ৮ লক্ষ টাকা করে ৯ বছরে ৭২ লাখ টাকা আদায় করা হয়। অতচ পরিদর্শন কালে বাৎসরিক ৮০ হাজার টাকা আদায়ের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ সন্তানসহ ২য় স্ত্রীকে অস্বীকৃতি লামার ইউপি সচিবের
চেয়ারম্যান ছাচিং প্রু মারমা কর্তৃক হাসান নামের স্থানীয় এক সংবাদকর্মীকে মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় হাসান বাদী হয়ে ছাচিং প্রু মারমাকে আসামী করে লামা আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছেন। (মামলা নং- ২২১/২০২১)। অভিযোগটি আমলে নিয়ে আদালত বিষয়টি লামা থানাকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়। হামলার শিকার সংবাদকর্মী হাসান দৈনিক প্রত্যয় নামে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে কর্মরত রয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদের একটি টয়লেটের নাজুক অবস্থার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করায় তিন ঐ সাংবাদিককে প্রহার করেন।
উল্লেখিত সকল অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান ছাচিং প্রু মারমার মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
Leave a Reply