
বাংলাদেশে সরকারের বহুল আলোচিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে চলছে তোলপাড়৷ এরইমধ্যে পাঁচজন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে৷ কাজ করছে তদন্ত কমিটি৷ আরো অনেক কর্মকর্তা শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন৷
আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে মুজিববর্ষ উপলক্ষে গত জানুয়ারি এবং জুন মাসে এক লাখ ১৮ হাজার ৩৮০টি ঘর হস্তান্তর করা হয়৷ এরইমধ্যে দেশের কয়েকটি এলাকা থেকে এই ঘরের মান নিয়ে অভিযোগ উঠেছে৷ কোনো কোনো এলাকায় নতুন মাটি ভরাট করে ঘর বানানোর কারণে তা ধসে পড়েছে৷
আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো সরকারি খাস জমির ওপর তৈরি করা হয়েছে৷ আয়তন ৪০০ বর্গফুট৷ প্রতিটি ঘরে আছে দুইটি কামরা, রান্নাঘর, বারান্দা এবং টয়লেট৷ এছাড়া ১০টি ঘরের জন্য একটি করে গভীর নলকুপ৷ সেমিপাকা এই ঘরগুলোর প্রতিটি তৈরি করতে প্রথম পর্যায়ে খরচ হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা৷ দ্বিতীয় পর্যায়ে খরচ হয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার টাকা এবং তৃতীয় পর্যায়ে দুই লাখ টাকা৷ প্রতিটি পরিবারকে দুই শতাংশ জমিসহ এই ঘর দেয়া হয়৷
কিন্তু ঘর দেয়ার আগে ও পরে নানা ধরনের অনিয়মের খবর প্রকাশ হয়৷ যেমন কুড়িগ্রামের রৌমারীতে হস্তান্তরের আগেই পাঁচটি ঘর ধসে পড়ে৷ গোপালগঞ্জে হস্তান্তরের পর অল্প সময়ের মধ্যেই ভেঙে পড়েছে দুইটি ঘর৷ ঘরগুলো বৃষ্টির কারণে বালু সরে গিয়ে ভেঙে পড়ে৷ লালমনিরহাটে ঝড়ো বাতাসে উড়ে গেছে দুইটি ঘর৷ বগুড়ায় দুই দিনের বৃষ্টিতেই একাধিক ঘর ধসে পড়েছে৷ বগুড়ার শেরপুরে কায়রাখালী বাজারের কাছে খালের পাড়ে নির্মিত ঘরগুলো এখন ভাঙ্গনের সম্মুখীন৷ বরগুনার আমতলীতে নির্মিত ঘরের গুণগত মান ঠিক নেই৷ সুনামগঞ্জের শাল্লায় ডিজাইন বহির্ভূত ঘর নির্মাণের অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন,নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করায় এই অবস্থা৷ আর এগুলো সরকারি ব্যবস্থাপনায়ই নির্মাণ করা হয়েছে৷ আবার এইসব ঘর বরাদ্দের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ গৃহহীনদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে৷
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এপর্যন্ত ২২ জেলার ৩৬ উপজেলায় ঘর তৈরিতে অনিয়মের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে৷ আরো অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে ৷ অনিয়মের অভিযোগে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে সাবেক ইউএনও (বর্তমানে উপসচিব) শফিকুল ইসলাম, বগুড়ার শেরপুরের সাবেক ইউএনও মো. লিয়াকত আলী শেখ (বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক), মুন্সীগঞ্জ সদরের সাবেক ইউএনও রুবায়েত হায়াত, বরগুনার আমতলীর ইউএনও মো. আসাদুজ্জামান ও মুন্সীগঞ্জ সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) শেখ মেজবাহ-উল-সাবেরিনকে ওএসডি করা হয়েছে৷
সারাদেশে এ ঘর নির্মাণে অনিয়মের শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেয়া হলেও বান্দরবান পার্বত্য জেলার তিন উপজেলার চিত্র যেন ভিন্ন। এখানে মুজিববর্ষে ভূমি ও গৃহহীন পরিবারকে দেয়া এই ঘর নির্মাণে ব্যপক অনিয়ম হলেও দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য সরকারি বরাদ্দের ঘর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই ঘরের পিলার ও বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে গেছে। নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী ইউনিয়নে উপকারভোগীদের ৪৩ ঘর নির্মাণেও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘর নির্মানে উপকারভোগীদের কাছ থেকে কাঠ, টিন, মালামাল, পরিবহন খরচসহ নগদ টাকা নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। লামা উপজেলার রুপসীপাড়া ইউনিয়নের ২ টি বাড়ি নির্মাণের আগেই একটির বাড়ির সামনের পিলার ভেঙে পরে অপরটি তে মারাত্মক ফাটল দেখা দেয়।
জানা গেছে, লামা উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে ১৭৫টি বিশেষ ডিজাইনের ঘর এর মধ্যে গজালিয়া ইউনিয়নে ৩০টি, লামা সদর ইউনিয়নে ৩০টি, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে ২৬টি, আজিজনগর ইউনিয়নে ৩৫টি, রুপসীপাড়া ইউনিয়নে ৩৫টি ও সরই ইউনিয়নে ১৯টি সেমি পাকা ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবগুলো ইউনিয়নের ঘর নির্মাণে অনিয়ম হলেও রূূপসী পাড়া ইউনিয়নের অনিয়ম চোখে পড়ার মত। রুপসীপাড়া ইউনিয়নে ৩৫টি ঘরের মধ্যে ২ টি বাড়ি নির্মাণের আগেই একটির বাড়ির সামনের পিলার ভেঙে পরে অপরটি তে মারাত্মক ফাটল দেখা দেয়।ঘটনা জানার পর এই অনিয়ম ঢাকতে তরিঘড়ি করে ৪ জুলাই পিলার টা ঠিক করে দেওয়া হয় তবে ফাটল ধরা বাড়িটি ঠিক করা হয়নি ১১ জুলাই পর্যন্ত।
আলীকদম উপজেলায় গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য সরকারি বরাদ্দের ঘর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই ঘরের পিলার ও বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে গেছে। নিম্মমানের কাজের অভিযোগ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। উপজেলার তারাবনিয়ায় গৃহহীন ইয়াছমিন আক্তারের নির্মাণাধীন ঘরের বারান্দার একটি পিলার ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে আছে ও ১২ ইঞ্জি পিএলসহ বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। নির্মাণাধীন ঘরের পাশে নিম্মমানের ইট ও কংক্রিট স্তুপ করে রাখা ছিল।
ইয়াছমিন আক্তার বলেন, প্রায় দুইমাস ধরে ঘরটি নির্মাণ কাজ চলছে। গত ১২ তারিখ পিলারটি ভেঙ্গে পড়ে, এর আগে একবার ভেঙ্গেছে ও পিএলসহ নির্মাণাধীন ঘরের বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে, বিষয়টি চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি। কিন্তু বিষয়টি তিনি দেখবেন বললেও তা এখন পর্যন্ত ঠিক করা হয়নি।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নে ভূমিহীণ ও গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ৪৩টি ঘরের প্রতিটি ঘরের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের মাধ্যমে ঘরগুলো বরাদ্দ দওয়া হয়েছে। তবে অলিখিত শর্তে উপকারভোগীর কাছ থেকে ঘরের ছাউনীর জন্য কাঠ, টিন আবার কারো কাছে মালামাল পরিবহণ বাবদ খরচ এবং শ্রম আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। নির্ধারিত ঘরের বরাদ্দ ছাড়াও মালামাল পরিবহণ বাবদ ইতোপূর্বে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অনুকূলে অতিরিক্ত পরিবহণ ব্যায় ও জ্বালানী ব্যয় এবং নিয়মিত কাজের গুণগতমান পিআইসি কর্তৃক পরিদর্শণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যানের যোগসাজোসে এসব ঘর নির্মাণ কাজে অনিয়ম আর দুর্নীতি জড়িয়ে পড়েছে। বাইশারী ইউনিয়নে নির্মিতব্য গৃহগুলো নিয়মিত পরিদর্শণ না করায় নিম্মমানের মালামাল দিয়ে এবং উপকারভোগীদের ঠকিয়ে কাজ করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।
এদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগের পর বাইশারী ইউনিয়নের কাগজীখোলা ২নং ওয়ার্ডের আথুইমং পাড়া এলাকায় সরেজমিনে তদন্ত করেছেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাদিয়া আফরিন কচি। ১ এপ্রিল তিনি ওই এলাকার তিনজন উপকারভোগীর সঙ্গে কথা বলেন। এসময় এক উপকারভোগী ছাউনীর জন্য ১২ হাজার টাকার কাঠ, এক গাড়ি বালি নিজেরা কিনেছেন বলে স্বীকার করলেও অন্যরা প্রকাশ্যে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন।
জানা গেছে, পিছিয়ে পড়া পারর্বত্য এই জেলার তিন উপজেলার ঘর নির্মাণের কাজটি তদারকি করছেন লামা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. মজনুর রহমান। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তার যোগসাজসেই স্থানীয় চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা মুজিববর্ষে গৃহহীনদের এই ঘর নিরর্মাণে হুরিলুট করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে লামা উপজেলা আওয়ামীলীগের এক সিনিয়র নেতা বলেন, মুজিব বর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের এই ঘর নির্মাণে শুধু এই প্রকল্প কর্মকর্তা অনিয়মই করছে না হুরিলুট করছে। তিনি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. মজনুর রহমান ও এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে এই বিষয়ে একাধিকবার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. মজনুর রহমানের মুঠোফোনে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে বক্তব্য চাওয়া হলে ফিরতি ক্ষুদে বার্তায় তিনি অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেন।
এই বিষয়ে লামা উপজেলা কর্মকর্তা রেজা রশিদ বলেন, লামায় মোট ৪২৫ টা বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। এই গুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে চেয়ারম্যান এবং মেম্বারদের। উপজেলা প্রশাসন সরাসরি এই কাজে সম্পৃক্ত না থাকলেও মনিটরিং করছে। প্রকল্পে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন যেখান থেকে অভিযোগ পাচ্ছি সেখানেই ব্যবস্হা নেওয়া হচ্ছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কোনভাবেই দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত নয় এবং উনার দুর্নীতি করার সেই সুযোগ টা ও এই প্রকল্পে নেই।
আলীকদম উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা সাঈদ ইকবাল বলেন, দুর্নীতি বা অনিয়মের বিষয়ে আমার কাছে কোন তথ্য নেই,তবে আপনি যদি আমাকে দুর্নীতি বা অনিয়মের বিষয়ে তথ্য দেন তাহলে আমি ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
তবে এই বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তার মুঠোফোনে ফোন করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, মুজিববর্ষে বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না— প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে দেশের সব ভূমি ও গৃহহীন পরিবারকে জমি ও গৃহ প্রদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ৬৯ হাজার ৯০৪টি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫৩ হাজার ৩৪০টি পরিবারকে এক সঙ্গে বিনামূল্যে জমি ও ঘর দেওয়ার হয়েছে। ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরের মধ্যেই আরও এক লাখ ভূমি ও গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ ঘর দেয়ার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
Leave a Reply