মাঠপর্যায়ে অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রযুক্তি জ্ঞান নেই

কম্পিউটার
ফাইল ছবি

ঢাকাঃ তথ্য ও প্রযুক্তিতে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। সরকারি অফিস আদালতের অধিকাংশ কাজ ডিজিটালি সম্পন্ন হচ্ছে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর অনেক কাজই অনলাইনে সম্পন্ন হচ্ছে। যা ই-ফাইলিং নামে খ্যাত।

মন্ত্রী-সচিবসহ শীর্ষ কর্তারা বিদেশে বসে ফাইলে স্বাক্ষর করছেন। ই-মেইলে মুহূর্তের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি বিনিময় হয় দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।

ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবার, ইমোসহ বিভিন্ন ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন হয়। দিন দিন তথ্য আদান-প্রদানের এ মাধ্যমগুলোর ব্যবহারও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। গত দু’বছর অধিকাংশ সরকারি বৈঠক ভার্চুয়ালি সম্পন্ন হয়েছে। এখনো হচ্ছে।

কিন্তু ডিজিটাল যুগেও রয়েছে এনালগ কর্মকর্তা-কর্মচারী। সরকারের মন্ত্রী সচিব থেকে নিয়ে কেরাণী পর্যন্ত অনেকেই প্রযুক্তির সাথে তাল মেলাতে পারছেন না। তারা এখনো সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন। ঢাকঢোল পিটিয়ে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল পদ্ধতির প্রয়োগের কথা বলা হলেও মাঠপর্যায়ে অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রযুক্তি জ্ঞান নেই। তারা হাতে লেখেই এখনো দায়িত্ব পালন করছেন। স্কুল-কলেজের অধিকাংশ শিক্ষকের কম্পিউটার লিটারেসি নেই। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে কম্পিউটার বিষয়ের শিক্ষক কম্পিউটার জানেন না।

সচিবালয়েও একই চিত্র। কম সংখ্যক মন্ত্রী আছেন যিনি ফাইলে ডিজিটালি মতামত লিখেন বা দেন। সচিবদের অনেকেই বসেন না কম্পিউটারে। যার কাজ সে যদি ডিজিটালি সম্পন্ন করতে পারতেন তাহলে তো সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক-কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে জনবল নিয়োগের দরকার হতো না। নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সারছেন পাশের ডেস্ক বা অন্য রুমের সহকর্মীদের সাহায্য নিয়ে।

অনেকেরই প্রশ্ন ডিজিটাল যুগে কেন এ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী কম্পিউটার জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ! এছাড়াও সরকারি অফিসগুলোতে ফোর-জি যুগে ইন্টারনেটের ধীরগতিতে গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে অনেকটায় সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ফলে অনেক সরকারি অফিসে নষ্ট হচ্ছে দৈনিক কর্মঘণ্টা। অনেক সময় সেবাগ্রহীতারা এসে পাচ্ছেন না তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা।

এছাড়াও অনেকেই অভিযোগ করে বলছেন এখন ডিজিটাল সেবার নামে চলছে নীরব চাঁদাবাজি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব রেজা (ছদ্মনাম)। দায়িত্ব পালন করেন প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরে। প্রতিমন্ত্রীর পার্সনাল অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন, ডেস্কে কম্পিউটার থাকলেও সেটা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।

শুধু মাত্র পিএবিএক্স ফোন সেট দিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। রেজাকে দায়িত্ব পালনকালে প্রতিমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ ই-ফাইলের তথ্য, গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের যোগাযোগ নম্বর ইত্যাদি কাগজ-কলমে নোট করে রাখতে হয়। ইন্টারনেট ক্লিকের মাধ্যমে তিনি কিছুই জানাতে পারেন না। বিশেষ সময় সহযোগিতা নিতে হয় সহকর্মীদের।
একই মন্ত্রণালয়ের লাইব্রেরিয়ান কাজ করছেন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক সংগ্রহশালা নিয়ে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এই লাইব্রেরির যে বইগুলো আছে তা স্ক্যানিং করে ই-ফাইলিং আকারে রাখা হবে। গত বছর এটা নিয়ে কাজ শুরু হলেও তা বর্তমানে থেমে আছে। এ ব্যাপারে সম্প্রতি লাইব্রেরি ঘুরে দেখা গেছে, বই নিয়ে ডিজিটাল কাজের গতি নেই। আগের অবস্থানেই বইগুলো থরে থরে সাজানো আছে।
সম্প্রতি লাইব্রেরিয়ান এর সাথে কথা হলে তিনি জানান, আগের সচিব স্যার থাকতে ডিজিটালের বিষয়ে কথা হয়েছিল। এখন তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। কবে ডিজিটাল সিস্টেম চালু হবে জানেন না তিনি।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল সুবিধা নিয়ে বেশ আলোড়ন ছড়িয়ে পড়লেও খোদ ভূমির মাঠ অফিসগুলো চলছে এনালগ সিস্টেমে। অভিযোগ আছে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সম্প্রতি এক চাকরিজীবী তার গ্রামের বসতবাড়ির ম্যাপ উঠানোর জন্য রাজধানীর ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে গেলে পড়েন বিড়ম্বনায়।

তিনি বলেন, ভূমি রেকর্ডের হেড অফিসে একজন বয়স্ক ব্যক্তি একটা কম্পিউটার নিয়ে শত শত লোকজনকে সার্ভিস দিচ্ছেন। এখানে একটা ম্যাপ উঠনোর জন্য গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিরিয়াল দিয়ে থাকতে হয়। ওই ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হেড অফিসেই যদি এমন ঢিলেমি অবস্থা হয় তাহলে মাঠ পর্যায়ে আরও যে কী অবস্থা!

জাতীয় প্রেস ক্লাবের উল্টো দিকে ভূমি রেকর্ড অফিসের আরও বেহাল দশা। সেকেলে অবস্থায় অফিসের বিভিন্ন কার্যক্রম সেবা নিয়ে অসন্তুষ্ট সাধারণ জনগণ। ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনায় কর্মীদের বিষয়ে বিরূপ ধারণা প্রায় অনেক গ্রাহকেরই। থানা পর্যায়ের ভূমি অফিসগুলোর নানান অভিযোগ এখন আরও বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সাধারণ জনগণকে তাদের জমির মালিকানা-খাজনা খারিজ করতে গিয়ে বিভিন্ন কাগজপত্রের ঝামেলায় পড়তে হয়। পরে তা নগদ অর্থের বিনিময়ে কাজ করে নিতে হয় বলে বেশির ভাগই অভিযোগ করেছেন।

এ ছাড়াও শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের সহকারী সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন তাহের (ছদ্মনাম)। কম্পিউটার সম্পর্কে তার নেই কোনো অগাধ জ্ঞান। টেলিফোন রিসিভ করেই দায়িত্ব পালন করছেন এ কর্মকর্তা।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী এ প্রতিবেদককে জানান, আমাদের এমনো কয়েকজন অফিস সহায়ক আছেন যারা কম্পিউটার কাজে পারদর্শী। তবে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের স্যার ডিজিটালে এত জ্ঞান রাখেন না। আবার অনেক মন্ত্রণালয়ে দেখা গেছে অতিরিক্ত/যুগ্ম সচিবদের কম্পিউটার সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকায় তাদের অনেকেই নিজের পার্সনাল অফিসারদের সহায়তায় অফিস সংক্রান্ত ডিজিটাল কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন।

বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, খাদ্য ছাড়াও বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ে এনালগ কর্মকর্তা-কর্মচারী অনেকরই দেখা মিলে। তবে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এসব মন্ত্রণালয়ের এনালগ এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ আর বেশি দিন নেই। কারও হয়তো চলতি বছর, আবার কারও দুই-তিন বছর চাকরির মেয়াদ আছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা তার সহকারীর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কম্পিউটার স্কিল বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ হচ্ছে, তারপরও অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা বিরাজ করছে যা একবারেই কাম্য নয় বলে জানান এ অতিরিক্ত সচিব। সচিবালয়ে ইন্টারনেটের গতি নিয়েও অনেকেই অসন্তুষ্ট।

কেউ কেউ বলেন, এখন সব কিছু ই-ফাইলিং হওয়ায় সার্ভারে চাপ বেড়েছে। তবে কর্মচারীরা বলছেন, থ্রি-জির সময়ে ইন্টারনেটের গতির যে অবস্থা আর এখন ফোর-জির সময় একই অবস্থা, কিছু তো পরিবর্তন দেখি না। আবার শুনছি ফাইভ-জি আসছে।

এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় পঞ্চম প্রজন্মের ইন্টারনেট বা ফাইভ-জি সেবা চালু করতে চায় রাষ্ট্রায়ত্ত মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটক। এ সেবা চালু করতে প্রতিষ্ঠানটি সরকারের কাছে ২৩৬ কোটি টাকা চেয়েছে। প্রাথমিকভাবে ঢাকার এক লাখ গ্রাহককে ফাইভ-জি সেবার আওতায় আনতে চায় টেলিটক।

এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে সরকারি দপ্তর ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এ সংক্রান্ত ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ফাইভ-জি প্রযুক্তি চালুকরণ’ প্রকল্পটি এখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফোর-জির সার্ভিসই তো জনগণ ভালোভাবে পাচ্ছে না। এখন আবার ফাইভ-জির কী দরকার। তারা সরকারকে সঠিকভাবে পরিকল্পনা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। টেলিটকের সেবা নিয়ে গ্রাহকদের আছে নানা অভিযোগ। কোম্পানিটির সেবার মান যে সন্তোষজনক নয়, তা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।

এতে বলা হয়েছে, টেলিটকের নেয়া প্রকল্পগুলো থেকে সুফল মিলছে না। আইএমইডি বলছে, টেলিটকের সেবার মান সন্তোষজনক নয়। এ প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক কাভারেজ অন্য অপারেটরদের চেয়ে অনেক কম।

তাছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় টাওয়ার বিটিএসের সংখ্যা কম হওয়ায় গ্রামপর্যায়ে নেটওয়ার্কের সমস্যা থাকে। টেলিটকের ইন্টারনেট সুবিধাও ভালো নয়। নেটওয়ার্ক মাঝে মধ্যে খুবই খারাপ থাকে।

এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, বেসরকারি অপারেটদের বিনিয়োগ কত আর সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সংস্থা টেলিটকের বিনিয়োগ কত— অংকটা তো সহজে এখানেই পাবেন।

মন্ত্রী বলেন, টেলিটকে এসব বেসরকারি অপারেটরদের প্রায় ১০ ভাগের এক ভাগ বিনিয়োগ আছে, তাহলে নেটওয়ার্ক কিভাবে অন্যদের সমান থাকবে। এক্ষেত্রে যদি বিনিয়োগ না করেন তাহলে কোনো অবস্থাতেই নেটওয়ার্ক ভালো করা যাবে না।

আইএমইডির কথা উল্লেখ করে মোস্তাফা জব্বার আরও বলেন, তাদেরকে এ বিষয়ে বিবেচনা করতে হবে। টেলিটকের নেটওয়ার্ক ভালো না বলেই তো সরকারকে বিনিয়োগ করতে হবে। ইন্টারনেট সেবার মান, গতি অবশ্যই বাড়াতে হবে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.