বন্ডের কাঁচামাল চোরাই পথে বিক্রি বেকা গার্মেন্টসের

ঢাকাঃ  বন্ডের কাঁচামাল ইপিজেডে প্রবেশই করেনি। অথচ কাস্টমস কর্মকর্তার সই জাল করে বানানো হয়েছে ভুয়া গেট পাস। বন্ডেড ওয়্যারহাউসে কাঁচামাল আনাই হয়নি, অথচ বানানো হয়েছে ভুয়া ডেলিভারি চালানপত্র। দুই মাস আগে বন্দর থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল খালাস নেয়া হয়েছে। সেই কাঁচামাল প্রতিষ্ঠানের ওয়্যারহাউসে না এনে লুকিয়ে রাখা হয়েছে চট্টগ্রামের একটি গোডাউনে। পরে তা চোরাই পথে খোলাবাজারে বিক্রির সময় জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া আগে আমদানি করা ২৮ লাখ গজ কাপড়ের মধ্যে ১৩ লাখ গজ কাপড়ের হদিস নেই। বন্ডিং মেয়াদ শেষ হলেও ৬ লাখ ৬০ হাজার গজ কাপড়ের পরিশোধ করা হয়নি প্রযোজ্য শুল্ককর। নারায়ণগঞ্জের আমদজী ইপিজেড এলাকার ‘বেকা গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইলস লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের এমন তথ্য উদঘাটন করেছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। প্রতিষ্ঠানকে পৃথক তিনটি কারণ দর্শানো নোটিস জারি করেছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ১৮ কোটি টাকা। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, বন্ড সুবিধায় আমদানি করা ৮৮ হাজার ৫৪৮ কেজি কাঁচামাল অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রির সময় জব্দ করে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। যাতে প্রায় ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা শুল্ককর ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এই নিয়ে ব্যবস্থা নিতে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটকে চিঠি দেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। সে অনুযায়ী ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট কারণ দর্শানো নোটিস করে। যাতে বলা হয়, কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণের তথ্য পায় ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কাস্টমস কর্মকর্তারা বেপজার সফটওয়্যার সিস্টেম হতে যাচাই করে দেখতে পায়, ২২ জানুয়ারি কাস্টমস কর্মকর্তার সই জাল করে আদমজী ইপিজেডের গেট পাস ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু পণ্যবাহী গাড়ি প্রবেশ করেছে কি নাÑতা কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। বিষয়টি যাচাইয়ে ১ ফেব্রæয়ারি কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। এতে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে পণ্য বন্ডেড ওয়্যারহাউসে প্রবেশ করেনি। প্রতিষ্ঠান তিনটি ডেলিভারি চালান দেখালেও পরবর্তীতে যাচাইয়ে দেখা গেছে, ওই তিনটি চালানের কোনো পণ্যই ওয়্যারহাউসে প্রবেশ করেনি।

অন্যদিকে, চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের প্রিভেন্টিভ টিম ২৭ জানুয়ারি বড়পোল মোড় এলাকা থেকে কাপড় বোঝাই দুইটি কাভার্ডভ্যান জব্দ করে। গাড়ির চালক কাস্টমস কর্মকর্তাদের বলেছেন, ওই কাপড় নরসিংদীর পাঁচদোনায় নেয়া হচ্ছে। গাড়িতে পণ্য চালানের চালান দেখান চালক। যাতে দেখা গেছে, দুই মাস আগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে কাপড়গুলো খালাস নেয়া হয়েছে। ২৯ জানুয়ারি প্রিভেন্টিভ টিম একই জায়গা থেকে কাপড় বোঝাই আরও তিনটি কাভার্ডভ্যান আটক করেন। এসব কাপড় দুই মাস আগে খালাস হয়েছে।

চালক জানিয়েছেন, ওই কাপড় বেকা গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইলস লিমিটেডের। পাঁচটি কাভার্ডভ্যানে জব্দ করা কাঁচামাল প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ইনভেন্ট্রি করা হয়। যাতে রয়েছে, ৪৯ হাজার ২৪০ গজ কাপড় ও ৪৮ হাজার ৩১৫ কেজি নেট। বন্ডের এসব কাঁচামাল বিনা শুল্কে বন্দর থেকে খালাস করে খোলাবাজারে বিক্রি করতে গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। অবৈধভাবে অপসারণ করা এ কাঁচামালের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ২ কোটি ৫১ লাখ ৫৯ হাজার ৪৮৪ টাকা। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর ২ কোটি ২৪ লাখ ৭২ হাজার ৪৫১ টাকা।

কাস্টমস কর্মকর্তার সই জাল করা, জাল ডেলিভারি চালান তৈরি, কাঁচামাল ওয়্যারহাউসে প্রবেশ না করে গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখা, অবৈধভাবে অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি এবং শুল্ককর ফাঁকির বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট।

অপরদিকে, প্রায় ১৩ কোটি টাকার বন্ডের কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ করেছে বলে অপর একটি মামলা করেছে বন্ড কমিশনারেট। যাতে প্রতিষ্ঠানটি শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা। ওই মামলায় ২১ মার্চ প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানো নোটিস জারি করা হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, বেকা গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইলস লিমিটেডের বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণের তথ্য পায় ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বন্ড কমিশনারেটের নিবারক দল ৩ ফেব্রæয়ারি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। যাতে বন্ড রেজিস্টার অপেক্ষা ওয়্যারহাউসে কম কাঁচামাল পাওয়া যায়। কাঁচামালের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফেব্রিক্স। এই নিয়ে পরিদর্শক দল একটি প্রতিবেদন দেয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের বন্ড রেজিস্টার অনুযায়ী, আমদানি করা কাঁচামালের (ফেব্রিক্স) পরিমাণ ২৮ লাখ ২৯ হাজার ৯২২ গজ। আর বন্ডেড ওয়্যারহাউসে পাওয়া গেছে ১৫ লাখ ৩১ হাজার ৫৬৬ গজ। অর্থাৎ বন্ড রেজিস্টার অপেক্ষা ১২ লাখ ৯৮ হাজার ৩৫৬ গজ ফেব্রিক্স কম পাওয়া গেছে। এই ফেব্রিক্সের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্য দিতে পারেননি। শুল্ককর ফাঁকি এই ফেব্রিক্স প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। অপসারণ করা কাঁচামালের পরিমাণ ১১ কোটি ৫৮ লাখ ২৫ হাজার ১৬৯ টাকা। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর ১০ কোটি ৩৪ লাখ ৫৫ হাজার ৪১ টাকা। শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই অবৈধভাবে কাঁচামাল অপসারণ করায় প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছে।

অপরদিকে, বন্ডিং মেয়াদ উত্তীর্ণ প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার গজ প্রতিষ্ঠানের ওয়্যারহাউসে পেয়েছে নিবারক দল। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানো নোটিস জারি করা হয়েছে। যাতে বলা হয়, নিবারক দল সরেজমিন পরিদর্শনের সময় বন্ডেড ওয়্যারহাউসে ১৫ লাখ ৩১ হাজার ৫৬৬ গজ বিভিন্ন ফেব্রিক্স মজুত পায়। যার মধ্যে ৬ লাখ ৬০ হাজার ৩৮৩ গজ বিভিন্ন ফেব্রিক্সের বন্ডিং মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। যার ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করেনি। এসব কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণের উদ্দেশ্যে মজুত রাখা হয়েছে, যা বন্ড লাইসেন্স বিধিমালার সুস্পষ্ট লংঘন। এই কাঁচামালের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১২ হাজার ২৪৯ টাকা। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর ৫ কোটি ২৬ লাখ ২০ হাজার ৪২১ টাকা। এই বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করেছে বন্ড কমিশনারেট। তিনটি কারণ দর্শানো নোটিসের ব্যাখ্যা দিতে প্রতিষ্ঠানকে ১৫ দিনের সময় দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে কয়েকদিন ধরে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মিকি দিয়াজ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ববি এন দিয়াজ ও প্রধান অর্থ কর্মকর্তা সঞ্জয় রায়কে বারবার ফোন করা হলেও তারা রিসিভ করেননি। এছাড়া বক্তব্যের বিষয় লিখে তাদের ব্যবহƒত মোবাইল নাম্বারে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো জবাব দেয়নি। হোয়াইসঅ্যাপ নাম্বারে বিষয় লিখে দেয়া হলে চেয়ারম্যান মিকি দিয়াজ ও প্রধান অর্থ কর্মকর্তা সঞ্জয় রায় সিন করলেও কোনো জবাব দেননি।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.