জন্ম না দিয়েও ২০০ শিশুর মা হাজেরা বেগম!

হাজেরা বেগমের মেয়ে ফারজানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে। হাজেরার স্বপ্ন সে যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। বাড়িতে তার আরো ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করছে। কলেজে পড়ছে দুই জন। স্কুলে পড়ছে ২৮ জন। তাদের মধ্যে এসএসসি দেবে দুই জন। স্কুলে যায় না চার জন। ওদের এখনো স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। এদের বেশির ভাগই যৌনকর্মীর সন্তান। হাজেরা নিজেও একজন যৌনকর্মী ছিলেন। এখন তাদের লালন-পালনের দায়িত্ব নিয়েছেন।

২৫ ছেলেমেয়ে নিয়ে শুরু হওয়া হাজেরার ‘শিশুদের জন্য আমরা’ সংগঠনে এখন ৪২ জন শিশু আছে। যার মধ্যে ১৮ জন মেয়ে ২৪ জন ছেলে। এরা সবাই নিজেদের ভাইবোন মনে করে। বড়রা ছোটদের দেখাশোনা করে। আর তাদের মা হাজেরা এই পরিবারের প্রধান হয়ে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। এরা হাজেরার নিজের ছেলেমেয়ে নয়, তবে হাজেরা বুক ভরা ভালোবাসা আর গভীর আবেগ নিয়ে বলেন, এরাই আমার সব। একযুগের এই সংগঠনে প্রায় ২০০-এর অধিক শিশু লালন-পালন করেছেন হাজেরা বেগম।

গতকাল শনিবার আদাবর সুনিবিড় হাউজিং-১৬ নম্বর রাস্তার তিনতলা বাড়ির উপর তলায় ৪২ সন্তান নিয়ে হাজেরার সংসারে দেখা গেল তাদের মধ্যে এখনো ঈদের আমেজ কাটেনি। সবারই হাতে মেহেদি। এক ঘরে ১৮ জন টিভিতে ঈদের অনুষ্ঠান দেখছে। কয়েক জন খাচ্ছে, খেলছে, কয়েক জন আবার লাইব্রেরিতে পড়ছে। সবার ছোট্ট ইসা ইব্রাহিমের বয়স চার বছর। সে একটু পর পর মায়ের কাছে আসছে। মা যা বলছে তা শুনে আবার চলে যাচ্ছে। চার-পাঁচ বছরের দুই জন মেয়ে প্রথমে, পরে দুই জন ছেলে এসে হাজেরা বেগমের গালে চুমু খাচ্ছে। হাজেরা বলেন, ‘দেখ্যান আপা আমি কত ভাগ্যবান। সন্তান জন্ম না দিয়েও সন্তানের ভালোবাসা পাই।’ সত্যিই তাই। তবে নিজের মা নেই, নিজের সন্তানও নেই—তারপর এত সন্তানের দেখাশোনার ইচ্ছা আর উপায় হলো কী করে ? জানান হাজেরার জন্ম ১৯৭১ সালে। মাকে তিনি দেখেননি। বাবা ২য় বিয়ে করলে তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়। কয়েক দফা হাতবদল হয়ে হাজেরা যৌনপল্লির বাসিন্দা হন। তখন দেখেন একজন মা—তার সন্তানদের জন্য, সন্তানদের সামনে কী করছে। এই অভিজ্ঞতা তাকে যৌনপল্লির শিশুদের জন্য কিছু করতে তাড়িত করে।

যৌনপল্লিতে থাকাকালীন ২০০০ সালে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্হার এইচআইভি-এইডস নিরোধ কার্যক্রমের আওতায় গঠিত যৌনকর্মীদের সংগঠন ‘দুর্জয় নারী সংঘে’ কাজ করেন তিনি। যৌনকর্মীদের সন্তানদের নিয়ে গঠিত হয় দুর্জয় শিশু নিবাস—এখানে হাজেরা প্রথম কাজ শুরু করেন। ২০০৮ সালে নিবাসটির জন্য বিদেশি সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়। হাজেরার খুব মন খারাপ হয় এই শিশুদের এখন কী হবে। অনেক যৌনকর্মী মা তাদের শিশুদের নিয়ে যান পতিতালয়ে। হাজেরা বেগম তাদের জন্য কিছু করার আশায় নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দেন। পরে হাজেরা বেগমের নিজস্ব জমানো টাকা দিয়ে শিশুদের দেখাশোনা শুরু করেন। তারপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যারা দুর্জয়ের শিশুদের সহায়তা করতেন, তারা হাজেরার পাশে এসে দাঁড়ান। তাদের সহায়তাসহ বিভিন্ন হৃদয়বান লোকের সহযোগিতায় হাজেরা ২০১০ সালে সাভারে ‘শিশুদের জন্য আমরা’ সংগঠনটি শুরু করেন। রাজধানীতে স্থানান্তরের পর শুধু যৌনকর্মীদের নয়, রাস্তার ভিক্ষুক, বাড়িতে ঠিকা ঝি-এর কাজ করা মায়েদের শিশুদের আশ্রয় হয় এখানে। এখানে এখন সব রকমের শিশুর থাকার ব্যবস্হা আছে। কয়েক জন শিশু বড় হয়ে বিয়ে করেছে। নিজেরা কাজ করে চলছে।

‘শিশুদের জন্য আমরা’ চলছে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটির মাধ্যমে। এটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন করা। এখানকার শিশুদের সাধারণ স্কুলে পড়তে কোনো বাধা নেই। সমাজের বিত্তবানরা শিশুদের জন্য দুধ, ডিম দিচ্ছেন। এই শিশুদের সঙ্গে অনেকে এসে জন্মদিন উদ্যাপন করছে। বিশেষ খাবার পাচ্ছে তারা। রোজায় প্রতিদিনই ইফতার এসেছে। ঈদে শিশুরা নতুন জামা পেয়েছে। ঈদের খাবারও এসেছে। হাজেরা তার ৪২ সন্তানের পছন্দমতো রান্না করেছেন। তাদের কাছে জানতে চেয়েছেন তারা কী খাবে। সেই অনুযায়ী রান্না হয়েছে। হাজেরা বলেন, আমি ভাবী ওদের সত্যিকারের মায়ের কাছে ওরা কী আবদার করত। মা তা কীভাবে মেটাত। আমিও তাই করব।

খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমাদের বাড়িভাড়া ৫০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে মাসে দেড় লাখ টাকার মতো খরচ হয়। নিজের টাকা আর সহযোগিতার মাধ্যমে চলে সংগঠন। তবে নির্বাহী কমিটি মনে করে আরো বেশি সহযোগিতা হলে আর একটু ভালো পরিবেশে শিশুদের মানুষ করা যেত।

হাজেরা বেগম এক জন শিশুকে দেখিয়ে বলেন, এর বয়স যখন তিন ঘণ্টা তখন আমার কাছে আসে। মায়ের দুধ খেতে না পেরে সে কী কান্না। আস্তে আস্তে কান্না কমে আসে। আর এক জনকে দেখিয়ে বলেন, ওর নাম সোহান। রেল স্টেশনে থাকত। এর বাবাই একে দিয়ে মাদকদ্রব্য বিক্রি করাত। ও নিজেও নেশা করত। নেশা করে ফ্লাইওভারের পিলার বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠত। এখানে প্রত্যেকটি শিশুর একটি গল্প আছে। এখানে আসার গল্পও আছে। যারা যৌনকর্মী তারা আমাকে বিশ্বাস করে নিজের সন্তান আমাকে দিয়ে যান। ভাবেন এখানে ওরা ভালো থাকবে, ঐ পরিবেশে মাকে দেখবে না। আমিও ওদের বোঝাই, তোমার মা তোমাদের ভালো থাকার জন্য এখানে দিয়ে গেছেন। তোমরা ভালোভাবে চলবে। ওরা বোঝে, নিজের মায়ের চেয়েও আমাকে বেশি ভালোবাসে। তাই হাজেরা নিজের সন্তানদের মতো তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, এই শিশুদের একটি নিজস্ব ভবন হবে। শিশুরা সেখানে ভালো মানুষ হবে। তাদের মায়েরাও একসময় বুড়ো হবে। কাজ করতে পারবে না। তাদের জন্য এখানে আশ্রয়কেন্দ্র হবে। ‘শিশুদের জন্য আমরা’ সংগঠনের মাধ্যমে আমি আমার সন্তানদের জন্য একটি নিরাপদ জীবন রেখে যেতে চাই।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.