যে জীবন মানুষের

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছি ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে। চাকরির সন্ধান করছি। মনে মনে ঠিক করেছিলাম- আমাকে আমার মতো দাঁড়াতে হবে। মাসখানেক পর চোখে পড়ল একটি বিজ্ঞাপন, দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়। ঢাকার বিআইডিএস (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ) দফতরে গবেষণা সহযোগী পদে লোক চায়। আমি আবেদন করলাম। ইন্টারভিউ-কার্ড আসে খুবসম্ভব ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে।

তবে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান সামাজিক বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপযোগী, সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের জন্য তেমন নয়। তবুও ইন্টারভিউতে ডাকার কারণ কী হতে পারে? আজকের দিনে তা হওয়ার কথা নয়। আমাদের সময়ে সে-পার্থক্য ছিল না। যোগ্যতা প্রমাণ করে যেকেউ যেকোনো চাকরিতে যেতে পারতেন। আমি পরের সপ্তাহে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ঢাকা যাব। ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে দেখা করতে। স্যার বললেন- যদি ঢাকাতে থাকতে চাও, সংবাদপত্রেও চাকরির চেষ্টা করতে পারো। বললেন, কবি শামসুর রাহমান দৈনিক বাংলার সম্পাদক, তার সঙ্গে দেখা করো।

তখনও আমার এমএ পরীক্ষার ফল বের হয়নি, স্যারকে বললাম একটা প্রশংসাপত্র দিতে। স্যার তাৎক্ষণিক নিজ প্যাডে একটা প্রশংসাপত্র লিখে দিলেন। তা নিয়েই ঢাকা চলে গেলাম। প্রশংসাপত্রটি ইংরেজিতে লেখা। তখনও পর্যন্ত ইংরেজির প্রচলন রয়েছে সর্বত্র। প্রশংসাপত্রে স্যার লিখলেন- ‘A young man of active habits Mr. Guha has an amiable disposition and a sense of responsibility which is rare. He has also earned some reputation as a poet’. এই সার্টিফিকেট নিয়ে ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৮/১৯ তারিখে ঢাকার পথে রওনা হলাম- প্রথমত চাকরির সন্ধানে; দ্বিতীয়ত লেখকজীবন গড়ে তোলার প্রত্যয়ে। আমার বিশ্বাস ছিল, সাহিত্য- সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি রাজধানী ঢাকায় গেলে আমার জন্য সবদিক থেকে সুবিধা হবে। এর মধ্যে ১৯৭৬ সালে বিভিন্ন সময়ে ও ১৯৭৭ সালের প্রথমদিকে দৈনিক বাংলা, দৈনিক ইত্তেফাক, মাসিক ঢাকা ডাইজেস্ট, সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীতে আমার কবিতা ছাপা হয়েছে। কবি হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই ঢাকার পথে পা বাড়িয়েছিলাম।

রাজধানী ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেছি বটে, কিন্তু সবই অচেনা, অপরিচিত। রাতের ট্রেনে যাত্রা করেছি চট্টগ্রাম থেকে। ঢাকা পৌঁছার কথা পরদিন ভোরে। চোখে আলোর ঝিলিক, মনে ভীতির চাপ- এ নিয়ে ঝিকঝিক শব্দে এগিয়ে চলেছে জীবনসন্ধানী এক তরুণ রাজধানী ঢাকায় প্রায় অনিশ্চিত গন্তব্যে। সারা রাত কানে বেজেছে ঝিকঝাক শব্দ, আর মাথার ভেতর খেলা করছে স্বপ্নের শিশুরা। শিরা-উপশিরায় শিহরন তুলছে রক্তপ্রবাহ। ঘুম ঘুম চোখে আঁধার পেরিয়ে দিনের আলোর অপেক্ষায় এক তরুণ যাত্রী; চোখে কবি হওয়ার স্বপ্ন। এ এমন বিলাসী স্বপ্ন অতি আপনজন ব্যতীত অন্য কাউকে বলা যায় না, বোঝানো যায় না। কবি হওয়ার স্বপ্ন- এ কেমন অবাস্তব কল্পনা এই সদ্য তারুণ্য-উত্তর যুবকের! তাই নিজ স্বপ্ন নিজের মনে পুষে দিনাতিপাত করছিলাম। ভোর হতে হতেই ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। মনে হচ্ছিল- অচেনা হলেও এ তো আমার শহর। মনে মনে আলিঙ্গন করলাম রাজধানী ঢাকাকে। স্টেশনে নেমে মুখহাত ধুয়ে নিলাম। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই সারি সারি রেস্টুরেন্ট। লোকের ভিড় দেখে আর ঢুকলাম না। লোকের কাছ থেকে জেনে নিলাম নারায়ণগঞ্জ যাবার পথ। জানলাম- গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জের বাস ছাড়ে। এক ঘণ্টার জার্নি। নারায়ণগঞ্জে থাকেন আমার পাড়ার বড়ভাই আশুতোষ নাথ। গ্রামে আমরা একসাথে বড় হয়েছি। আমাদের এলাকা থেকে তিনি প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া, আমি দ্বিতীয়জন। কারও সঙ্গে বেশি কথা বলছি না, অচেনা জায়গা বলে।

কমলাপুর স্টেশন থেকে একটা রিকশা নিয়ে চলে এলাম গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডে। নেমেই দেখি, পাশে দুই-তিনটা মিষ্টির দোকান, রাস্তার অপর পাড়ে। রাস্তা পার হয়ে একটিতে গিয়ে বসলাম। মিষ্টি আমার খুবই পছন্দের বস্তু। মিষ্টি আর লুচি দিয়ে সকালের নাশতা হয়ে গেল। মিষ্টির দোকানে চা রাখে না। সকালের নাশতা সেরে বিশ্রাম নিতে নিতেই রোদ উঠে গেছে। গিয়ে নারায়ণগঞ্জের বাসে উঠলাম। এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগল পৌঁছতে। পথে থেমে থেমেই গেছে স্টিলবডির বড় বাস। যাত্রাবাড়ী, ধোলাইরপাড় হয়ে নারায়ণগঞ্জ। চাষাঢ়া এসে বাস থামল। বাস থেকে নেমে ঠিকানা চেনার চেষ্টা করলাম। কোনদিকে যাব? একটা রিকশা ডেকে বললাম বাসার ঠিকানা। রিকশাচালক পাঁচ টাকা ভাড়া চাইল। উঠে পড়লাম রিকশায়। দেখি, দুই-তিন মিনিটের মধ্যে বাসার গেটে। দূরত্ব ছিল দুইশ গজের মতো! বাসায় পৌঁছে মুখহাত ধুয়ে অপেক্ষা করছিলাম আশুদার জন্য, তিনি তখন অফিসে। বাসা থেকে ফোন করে তাকে জানানো হলো। ঘণ্টা দুয়েক পর অফিস থেকে চলে এলেন তিনি। আমাকে পেয়ে খুব আনন্দিত সবাই। অনেকক্ষণ গল্পগুজব করলাম। বাড়ির খবরাখবর জানলেন। দুপুর হয়ে এলো। একসাথে খেয়ে নিলাম। আশুদা আবার অফিসে চলে গেলেন।

মাথার ভেতর নানা চিন্তা। চাকরির কী ফল হবে, এরপর কীভাবে ঢাকায় থাকব- নানান কিছু। সন্ধ্যার দিকে আশুদা অফিস থেকে এলেন। এসেই আমাকে নিয়ে বের হলেন বাজারে। দুজন অনেক বছর পর একসাথে ঘুরে ঘুরে বাজার করলাম। অনেক রাত পর্যন্ত সময় কাটল গল্পে গল্পে। যতদিন সে-বাসায় ছিলাম অতি যত্নের মধ্যেই ছিলাম। তবে আমার মধ্যে চেষ্টা ছিল- কত তাড়াতাড়ি নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়। এই যে ঢাকা এসে দাঁড়াবার ঠাঁই পেয়েছিলাম- তাতেই নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া সহজ হয়েছিল। বিআইডিএস-এ আমার ইন্টারভিউ ছিল খুবসম্ভব ২৫ বা ২৬ তারিখ। জীবনে প্রথম ইন্টারভিউ নয়। এর আগে খেলাচ্ছলে দুটো ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। চাকরি হয়েছিল, যাওয়া হয়নি। তখন পাঠরত ছিলাম এবং সেসব চাকরি আমার আগ্রহ অনুযায়ী ছিল না।

চোখে অনেক স্বপ্নের হাতছানি। তখন সরকারি, বেসরকারি, প্রাইভেট নির্বিশেষে চাকরির জন্য প্রার্থী হচ্ছি। ঢাকায় থাকতে হলে চাকরি দরকার, যেকোনো চাকরি। কবিতাই প্রথম এবং প্রধান আরাধ্য; চাকরি হবে টিকে থাকার উপায়। নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে ঢাকার বিআইডিএস অফিসে লিখিত পরীক্ষা দিলাম। সুতরাং এখানে চাকরি হলেও অন্যত্র খুঁজতে হবে অন্য চাকরি- যা আমার স্বভাবের সাথে যায়। তবে সে চাকরি আমার হয়নি। মনও খুব খারাপ করিনি। এর মধ্যে আমার হাতে থাকল আরও কয়েকটি চাকরির হাতছানি। আমি তখন নিয়মিত ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ও ইংরেজি পত্রিকা ‘দৈনিক অবজারভার’ পড়তাম; শুধু চাকরির বিজ্ঞাপনের জন্য। চাকরির জন্য উঠেপড়ে লাগা যাকে বলে! আমার প্রাণপণ চেষ্টা ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানো, দ্রুততম সময়ে। আশুদার (আশুতোষ নাথ) সঙ্গে আলাপ করে ঠিক করলাম, চট্টগ্রামে আর ফিরে যাব না। ঢাকায় আমাকে টিকে থাকতে হবে। আমার চাকরির আর একটা ক্ষেত্র ভেবে নিয়েছিলাম সাংবাদিকতা। অনেকগুলো বায়োডাটা, ছবি প্রস্তুত। পত্রিকায় কোনো বিজ্ঞাপন চোখে পড়লেই বাদ যাচ্ছে না দরখাস্ত না-করে। ১৯৭৮ সাল শুরু। আমি চাকরির জন্য পাগলের মতো ছুটছি; তখন কবিতা লেখাও চলছে নিয়মিত।

পৃথিবীতে কিছু কিছু বিচিত্র ধরনের মানুষ রয়েছে, সব দেশে- যারা কোনো বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হলে ডানে-বাঁয়ে আর তাকাতে চায় না। এরা হচ্ছে সাহিত্যপাগল মনুষ্যকুল। তারা না-চায় দৌলত, না-চায় আয়েশ- চায় খ্যাতি, নিজেকে প্রকাশের আকুল আকুতি। সেই বৈরাগ্য সাধনকে কেউ পছন্দ করে যদি এর সঙ্গী হতে চায়, তবে তো কথাই থাকে না! এরা ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্নবিলাসী! আমার বেলায়ও তাই হয়েছে; না চাই জৌলুসের চাকরি, ধন বা দৌলত। চাই শুধু নিজেকে প্রকাশের সুযোগ; চাই সমাজকে আলোর পথ দেখানোর জন্য নিজের ভাবনা প্রকাশের প্লাটফরম। এই পথ কঠিন সাধনার পথ! তখন আমার দৃষ্টি থেকে কিছু বাদ যাচ্ছে না। পত্রিকায় দেখলাম কোহিনূর শিল্প গোষ্ঠী তাদের উৎপাদিত একটি পণ্যের নাম চেয়েছে, যা ছিল কাপড় ধোয়ার পাউডার। আমি নাম পাঠালাম- ডঅঝঐ অর্থাৎ ওয়াশ পাউডার। আমার নামটা নির্বাচিত হলো। ১৯৭৮ সালের ১২ জানুয়ারি সে-নাম ঘোষণা করা হলো। আমার আনন্দ আর ধরে না। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। ভাবলাম, আমার চিন্তাও অন্যকে প্রভাবিত করতে পারে! যদিও এটা কোনো বড় বিষয় নয়, একটা পণ্যের বাজারমুখী সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি নামমাত্র। তবে যারা সৃষ্টিশীল কাজ করেন- তাদের চিন্তা সমাজকে প্রভাবিত তো করতে পারে। আমরা সে সাধনায় রত। তাই চাকরি প্রধান নয়, চাকরিটা হলো এই গ্রাম্য-আগন্তুকের ঢাকায় টিকে থাকার উপায় মাত্র।

আমার কবিতার ভাবনা পাখা মেলে উড়তে চায় আকাশে। কিন্তু ওড়ার জন্য পাখায় শক্তি দরকার। সে শক্তি আহরণ করতে হয় মনোবল থেকে, বিগতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে- যার মোহন আলো কবির দৃষ্টিকে হঠাৎ ঝলসিয়ে দিয়ে যায়! মনোবল আমার প্রধান অবলম্বন। এখন কোনো চাকরি নেই। অন্যের বাসায় থেকে খেয়েদেয়ে আনন্দে গান গেয়ে উঠব, আর স্বপ্নের চাষাবাদে নিরত থাকব- তা কী করে হয়! তাই শারীরিকভাবে এবং মানসিকভাবে ছুটে বেড়াচ্ছি সারা দিন। এখানে ওখানে, লাইব্রেরিতে, হকারের স্টলে দাঁড়িয়ে পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাচ্ছি- কোথায়, কোন পদে কর্মী নিয়োগ হবে! আশুদার নিকটাত্মীয় শ্রীবিধুভূষণ নাথ বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আমাদের সঙ্গে বেশ আগে থেকেই ঘনিষ্ঠ। একদিন চলে গেলাম তার মতিঝিলের অফিসে। তিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন। বললাম, চাকরির সুযোগ কি কোথাও পাওয়া যাবে? যেদিকে পদ খালি দেখি- আবেদন করছি। তিনি উৎসাহ দিলেন। আমার প্রতি তার স্নেহ যেমন ছিল, তেমনি আস্থাও ছিল। বললাম, কোনো বেসরকারি অফিসে হলেও আপাতত শুরু করি, কোথাও কোনো ভালো সুযোগ পেলে পরে তা দেখা যাবে। বললেন, একটা বায়োডাটা একসময় দিয়ে যেও। আমি পরেরদিনই একটা বায়োডাটা তার হাতে দিয়ে এলাম।

ঢাকায় আসার পর কবি শিহাব সরকারের সঙ্গে প্রথম আলাপ, তার নিউ নেশনের অফিসে। টিকাটুলির ইত্তেফাক ভবনে। শিহাব আমার একই সময়ের কবি হলেও তখন ঢাকায় তার বেশ পরিচিতি। আর আমি চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ঢাকা এসেছি। শিহাব সরকার ও আবিদ আজাদ আমাদের সময়ের দুই অগ্রণী কবি, যাদের সঙ্গে লেখালেখির সুবাদে চট্টগ্রাম থেকেই আমার যোগাযোগ। কখনও আবিদ আজাদের অফিসে চলে যেতাম।

আমার কবিতা লেখা চলছে। বেশ কিছু কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সে-সময় কবিতা হাতে-লিখে সম্পাদকের দফতরে জমা দিয়ে আসতে হতো, অথবা ডাকে পাঠাতে হতো। আমার ডায়রিতে লেখা নোট অনুযায়ী ১৯৭৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গিয়েছিলাম দৈনিক বাংলা অফিসে কবি আহসান হাবীবের কাছে। তিনি পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। খ্যাতিমান কবি ও প্রবাদতুল্য সাহিত্য সম্পাদক। এখনও পর্যন্ত আহসান হাবীবের বিকল্প সাহিত্য সম্পাদক বাংলাদেশে তৈরি হয়নি, একথা সর্বজনবিদিত। কবি আহসান হাবীব প্রথম সাক্ষাতেই সন্তানবৎ স্নেহ করলেন। আমার কবিতা লেখা, চট্টগ্রামের সাহিত্যচর্চা ইত্যাদি প্রসঙ্গে আলাপ হলো। বড়-ছোট সবাই তাকে ডাকতেন- হাবীব ভাই। দৈনিক বাংলায় এর আগে আমার একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল, চট্টগ্রাম থেকে ডাকে পাঠিয়েছিলাম। আমার খোঁজখবর জানতে চাইলেন, বললাম- ঢাকা এসেছিলাম চাকরির ইন্টারভিউ দিতে, এখন আছি চাকরির সন্ধানে। বললাম, নারায়ণগঞ্জে এক প্রতিবেশী বড়ভাইয়ের বাসায় উঠেছি। আমি সঙ্কোচবোধ করছিলাম- এত বড় কবির সঙ্গে কথা বলছি! তিনি আন্তরিকভাবে কথা বলছিলেন। আমার তখন মনে হয়েছিল- অভিভাবকের সঙ্গেই কথা বলছি। একসময় তার হাতে একটি কবিতা দিলাম দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতার জন্য। দুই-তিন সপ্তাহ পরেই তা প্রকাশিত হয়েছিল। দিনটি আমার স্মৃতিতে জাগরূক হয়ে আছে এখনও।

আহসান হাবীব কলকাতা থেকে এসে প্রথমদিকে দৈনিক আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী, দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। ১৯৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তা দৈনিক বাংলা নামকরণ হয়। আমৃত্যু অর্থাৎ ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক রূপে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সে সময়ে দৈনিক বাংলায় লেখা প্রকাশকে যেকোনো নতুন লেখকের স্বীকৃতি বোঝাত। সে সুযোগে আমিও পেয়েছি অভিভাবকতুল্য ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শ। কবি আহসান হাবীব, আর সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীব দুই সত্তা মিলে হয়ে উঠেছিলেন আমাদের কবিতার অভিভাবক। কবিতা নিয়ে গেলে তার সামনে গিয়ে বসতে হতো। কুশল জিজ্ঞাসা করে বলতেন, কবিতা এনেছ- দাও। হাত বাড়িয়ে কবিতা দিতাম তার হাতে। তিনি তার সহকারী নাসির আহমেদকে কবিতাটা দিয়ে বলতেন- পড়ো। নাসির পড়তেন, আর এদিকে আমার বুকে কাঁপন শুরু হতো- কী জানি হাবীব ভাই কী বলেন! পড়া হলে প্রায়শই দেখেছি, বলতেন -ঠিক আছে ফাইলে রাখো। আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম।

কবিতার হাত ধরে ঢাকা এসেছি। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত চাকরির সন্ধান করছি, আর লিখে যাচ্ছি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিতও হচ্ছে কবিতা। যাতায়াত শুরু করলাম বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমিতে। বাংলা একাডেমিতে গিয়ে প্রথম পরিচিত হয়েছিলাম বিজ্ঞান-লেখক তপন চক্রবর্তীর সঙ্গে। তার বাড়ি আমাদের কাছাকাছি, একই থানায়। পরে একে একে পরিচিত হলাম কবি ও কথাসাহিত্যিক আসাদ চৌধুরী, সুব্রত বড়ুয়া, রশীদ হায়দার, রফিক আজাদ, সেলিনা হোসেন, মুহম্মদ নুরুল হুদা ও ওবায়দুল ইসলামের সঙ্গে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা এলেই একবার বাংলা একাডেমিতে যেতাম। আর যেতাম শিশু একাডেমিতে। সেখানে ছিলেন কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাশ বড়ুয়া ও আবু সাঈদ জুবেরী। জুবেরীকে পেয়ে ভালো লাগল- তার ওখানে বেশিক্ষণ আড্ডা হতো! সে সময়টাকে নিয়ে যে কবিতা লিখেছিলাম, ডায়রির পাতা জুড়ে আছে- ছাপা হয়নি কোথাও। তা কেবলই মনের অনুভূতিরই প্রকাশ- ‘আমার স্থায়িত্ব নিয়ে অন্য কোনো দুর্ভাবনা নেই/ যখন যেখানে থাকি-/ আমার স্বাক্ষর মুক্তপাখির ডানায় এঁকে যাব/ কারো কোনো অবহেলা বালখিল্যজনিত বিরোধ/ কোনো অহংকার নাড়াতে পারবে না আমাকেই/ প্রতিদিন এঁকে যাব আমার স্বাক্ষর/ উড্ডীন পাখির ডানায়।’

একদিন পত্রিকায় দেখলাম- ঢাকাস্থ ‘কিংবদন্তীর আমরা’ জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারেরর জন্য গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ আহ্বান করে ১৯৭৮ সালের প্রথম দিকে। আমি কবিতা জমা দিয়েছিলাম। সারা দেশের প্রতিযোগিতায় কবিতায় প্রথম হয়েছিলাম আমি, দ্বিতীয় হয়েছিলেন ঢাকার গেণ্ডারিয়ার সৈয়দা জিনাত আরা; ছোটগল্পে প্রথম হয়েছিলেন ইসহাক উদ্দিন ইনু (পরে ইসহাক খান নামে তিনি খ্যাত হয়েছেন), দ্বিতীয় অহিদুল ইসলাম বাবু। ১৯৭৮ সালের ১৬ এপ্রিল ঢাকার লালকুঠির মঈনউদ্দীন মেমোরিয়াল হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানের সভাপতি সাহিত্যিক সরদার জয়েনউদ্দিন বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। সেদিন ছিল রোববার। আমি চট্টগ্রামে থাকায় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারিনি। ঢাকা ফিরে এসে তাদের নিকট থেকে পুরস্কার সংগ্রহ করার অনুরোধপত্র পেলাম এবং পরদিন গিয়ে পুরস্কার সংগ্রহ করে এনেছিলাম। তখন কী আনন্দ আমার!

১৯৭৮ সালের প্রথমার্ধে কবিতা প্রতিযোগিতা আহ্বান করে- তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ পরিষদ’। তখন মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে উপলক্ষ করে তরুণদের মধ্যে একুশের চেতনাকে জাগরূক রাখার প্রয়াসে আয়োজন করা হতো দেশব্যাপী তরুণ সাহিত্য প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল- কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও নাটক। উদ্দেশ্য- সারা দেশ থেকে তরুণ সাহিত্যপ্রতিভা খুঁজে বের করা। পুরস্কার দেওয়া হতো প্রত্যেক বিষয়ে একজন করে- জাতীয় পর্যায়ে, বিভাগীয় পর্যায়ে ও জেলা পর্যায়ে। প্রতিযোগিতার নিয়ম ছিল- প্রতি জেলায় বিষয়ভিত্তিক কবিতা, গল্প, নাটক ও প্রবন্ধে যারা প্রথম হবে, তাদের আবার প্রতিযোগিতা হবে বিভাগীয় পর্যায়ে, পরে সেখান থেকে শ্রেষ্ঠদের জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করা হবে। বিচারকমণ্ডলীতে থাকতেন বিশিষ্ট সাহিত্যিকবৃন্দ। কবিতা, গল্প, নাটক ও প্রবন্ধে প্রতি বিষয়ে একজন করে দেশের ৪ জন শ্রেষ্ঠ তরুণ লেখককে জাতীয় পর্যায়ে শিরোপা দেওয়া হতো। বাকিদের মধ্য থেকে বিভাগীয় এবং জেলা পর্যায়ে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হতো। আমি কবিতায় জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ তরুণ কবির শিরোপা লাভ করি ১৯৭৯ সালে। সেবছর ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার এক জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশসেরা ৪ জন তরুণ সাহিত্যিকের হাতে এই শিরোপা তুলে দেন। অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন কবি সানাউল হক। পুরস্কার স্বরূপ একটি তামার ক্রেস্ট ও এক হাজার টাকা সম্মানী প্রদান করা হয়।

উৎসাহ মানুষকে অনেকদূর এগিয়ে দেয়। এটা মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। উৎসাহ শব্দে প্রশংসাবাচক অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটে। এই উৎসাহের প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। মানুষের কোনো কাজ, উক্তি, প্রবণতা, কর্মোদ্যম যদি সর্বমানবের পক্ষে হয়, তা যদি চেতনাবিকাশের কিংবা মানুষের কল্যাণের পক্ষে হয়; মানুষ তাকে বাহবা দেয়। তাকে দূরের পথের যাত্রী হওয়ার আহ্বান জানায়। পুরস্কারও এই ধরনের প্রশংসা ও উৎসাহজ্ঞাপক আয়োজন। তাই মানবসমাজে নানা পন্থায় পুরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে। ছোটদেরকেও উৎসাহ ও প্রশংসার মধ্য দিয়ে এগিয়ে দিতে হয়। তা জাতির জন্য ও পরিবারের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে নিঃসন্দেহে। সেজন্য একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে- যে দেশে গুণীর কদর হয় না; সে দেশে গুণী জন্মায় না।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.