আজও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত শ্রমিকরা

পোশাক শ্রমিক

যাদের শ্রম-ঘাম-রক্তে দেশের অর্থনীতির ভিত রচিত হয়, সেই পোশাক শ্রমিকরা যেন সবসময় ‘সুবিধাবঞ্চিত’ হন। কর্মস্থলে দীর্ঘসময় টানা কাজ করে অসুস্থ হয়ে পড়লেও পান না সুচিকিৎসা। নেই সরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থাও। এতে বিভিন্ন জটিল রোগের ঝুঁকিতে থাকেন তারা।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) নিবন্ধিত কারখানার সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার। আর এগুলোতে কাজ করেন ৪২ লাখের বেশি শ্রমিক। এসব শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় দেশের ৬৪ জেলায় মাত্র ৩২টি শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র থাকলেও সেগুলোর আবার অর্ধেকেই নেই চিকিৎসক। ৪২টি পদের বিপরীতে সরকারি নিজস্ব চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৯ জন।

এই অবস্থায় ‘সস্তা শ্রমের বিনিময়ে’ কাজ করা এসব শ্রমিকদের চিকিৎসা সেবায় বাধ্য হয়েই নির্ভরশীল হতে হয় বেসরকারি হাসপাতালের ওপর। আর পারিবারিকভাবে অসচ্ছল হওয়ায় স্বাস্থ্যের দিকটি বরাবরই অবহেলিত থাকে এসব শ্রমিকদের। কাজ করে তারা যে পারিশ্রমিক পান, তা দিয়ে কোনোমতে চলে সংসার। তাই তাদের কেউ অসুস্থ হলে অর্থের কারণে নিতে পারেন না সঠিক চিকিৎসা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অসুস্থতাজনিত কারণে একজন পোশাক শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে মাসে গড়ে ৪ দিন অনুপস্থিত থাকায় কাটা পড়ে বেতন। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন পোশাক খাতে কাজ করা নারীরা।

গবেষণা বলছে, বছরে শতকরা ৪৩ শতাংশ পোশাক শ্রমিক নানা রোগে আক্রান্ত হলেও, টাকার অভাবে এবং সরকারি পর্যায়ে ভালো কোনো চিকিৎসার সুযোগ না থাকায় তাদের ৪০ শতাংশ সময়মতো চিকিৎসা নিতে পারেন না।

৩২টি শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রের ১৬টিতেই চিকিৎসকের পদ শূন্য

শ্রম অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারাদেশে শ্রমঘন এলাকাগুলোতে ৩২টি শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র শ্রমিকদের কল্যাণে বিভিন্ন সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সেবাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো শ্রমিক ও শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা সেবা। শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রে স্বাস্থ্য সেবা দিতে চিকিৎসক পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অধিকাংশ শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রে চিকিৎসক পদটি শূন্য থাকায় অসুস্থ শ্রমিকরা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

জানা গেছে, শ্রম অধিদপ্তরের অধীন বর্তমানে ১০ জন চিকিৎসক স্থায়ী পদে নিয়োজিত আছেন। তার মধ্যে এক জন প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত, আর বাকি ৯ জন চিকিৎসক ৯টি কেন্দ্রে স্থায়ীভাবে কাজ করছেন। এছাড়াও ৯ জন চিকিৎসক চুক্তিভিত্তিক ৯টি কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করছেন। ৯ জন অস্থায়ী চিকিৎসকের মধ্যে ৪ জন চিকিৎসক দৈনিক ৪ ঘণ্টার জন্য নিয়োজিত। তাদের কর্মঘণ্টা বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত, বাকি ৫ জন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করেন।

সবমিলিয়ে স্থায়ী ও অস্থায়ী চিকিৎসকরা মোট ১৬টি কেন্দ্রে সেবা দিচ্ছেন। বাকি ১৬ কেন্দ্রের পদ শূন্য আছে।

স্থায়ীভাবে চিকিৎসক নিয়োগ পাওয়া শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রগুলো হলো- চট্টগ্রাম কালুরঘাট শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, খুলনা খালিশপুর শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গল শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, গাজীপুর টঙ্গী শ্রম কল্যাণ কেন্দ্ৰ, নারায়ণগঞ্জ চাষাড়া শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, খুলনা রুপসা শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, নারায়ণগঞ্জ বন্দর শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আশুগঞ্জ শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র।

অস্থায়ীভাবে (চুক্তিভিত্তিক) চিকিৎসক নিয়োগ পাওয়া কেন্দ্রগুলো হলো- বগুড়া চকসূত্রাপুর শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গল শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম ষোলশহর শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, কুষ্টিয়া শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, সিলেট জৈয়ন্তাপুর শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, মৌলভীবাজার পাত্রখোলা শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, মৌলভীবাজার সমশেরনগর শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, নিলফামারী সৈয়দপুর শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র।

চিকিৎসকের পদ শূন্য থাকা শ্রম কেন্দ্রগুলো হলো- নরসিংদী সাটিরপাড়া শ্রম কল্যাণ কেন্দ্ৰ, নরসিংদী পলাশ ঘোড়াশাল শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, বরিশাল আমানতগঞ্জ শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, বাগেরহাট মোংলা শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, লালমনিরহাট শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, সিরাজগঞ্জ শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, রাজশাহী সপুরা শ্রম কল্যাণ কেন্দ্ৰ, হবিগঞ্জ চুনারুঘাট চন্ডিছড়া শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, মৌলভীবাজার কুলাউড়া কাপনাপাহাড় শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গল ফুসকুড়ি শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, চাঁদপুর শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, নোয়াখালী চৌমুহনী শ্রম কল্যাণ কেন্দ্ৰ, জামালপুর সরিষাবাড়ি শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, রাঙামাটি ঘাগড়া শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, মৌলভীবাজার কুলাউড়া লোহাইউনি শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, গাইবান্ধা শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র।

চিকিৎসক নিয়োগে বাধা নিয়োগ বিধি : শ্রম মহাপরিচালক

শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী (এনডিসি) বলেন, সারাদেশে আমাদের মোট ৩২টি শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ‘এ’ ক্যাটাগরির দশটি এবং বাকি ২২টি ‘বি’ ক্যাটাগরির। এ ক্যাটাগরির যে শ্রম কেন্দ্রগুলো রয়েছে, সেগুলোতে একজন সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ও একজন মেডিকেল অফিসার থাকার কথা। কিন্তু সে অনুযায়ী আমাদের অধিকাংশ কেন্দ্রেই চিকিৎসক নেই। ‘বি’ ক্যাটাগরির কেন্দ্রগুলোতে একজন করে মেডিকেল অফিসার থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটিতে।

তিনি বলেন, সব মিলিয়ে নিজস্ব সরকারি ও আউটসোর্সিং মিলিয়ে ১৬টি কেন্দ্রে চিকিৎসক রয়েছে। বাকি ১৬টি শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রেই আমরা নিয়োগ দিতে পারছি না। কারণ আমাদের নিয়োগ বিধিটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সর্বশেষ যতটুকু জানি, নিয়োগবিধি পিএসসি থেকে চূড়ান্ত হয়ে সেটি এখন আইন মন্ত্রণালয় আছে। সেখানে অনুমোদন হয়ে গেলেই আমরা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যেতে পারব।

অল্প চিকিৎসক দিয়ে কীভাবে সেবা দিচ্ছেন জানতে চাইলে খালেদ মামুন বলেন, পদ অনুসারে আমাদের নিজস্ব চিকিৎসক নেই বললেই চলে। এই অবস্থায় আমরা আমাদের শ্রম কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করতে পারছিলাম না। এরপর শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনকে চিঠি দিয়ে সহযোগিতার আহ্বান জানালে শ্রমিকদের কল্যাণে তারা কিছু অর্থায়ন চালু করে। এর মাধ্যমে আউটসোর্সিংয়ে আরও কিছু চিকিৎসক আমরা নিয়োগ দিয়েছি। তবু আমাদের প্রায় অর্ধেকের মতো শ্রম কেন্দ্রে চিকিৎসক না থাকায় শ্রমিকরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

শ্রম মহাপরিচালক বলেন, সারাদেশে আমাদের অসংখ্য শ্রমিক, সে তুলনায় শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রও স্বল্প। এর মধ্যে যেগুলো রয়েছে সেগুলোতেও যদি প্রয়োজনীয় চিকিৎসক আমরা পাই, তাহলে বিশাল সংখ্যক শ্রমিককে আমরা সেবার আওতায় আনতে পারব।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সরকার শ্রমবান্ধব। সরকারের ইচ্ছা আছে শ্রমিকদের কল্যাণে ভালো কিছু করার। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, হয়তো আগামী দুই মাসের মধ্যেই নিয়োগের অনুমোদন পেয়ে যাব। এর পরপরই আমাদের প্রয়োজন মতো চিকিৎসকের চাহিদা দেব এবং নতুন চিকিৎসক আমরা নিয়ে নিতে পারব।

প্রসঙ্গত, সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রদত্ত স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সেবা দিতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে শ্রম অধিদপ্তর অধীন শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র বদ্ধপরিকর। তবে শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসা কর্মকর্তা, জনসংখ্যা ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা, ফার্মাসিস্ট, পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা, ডিসপেনসারি অ্যাটেনডেন্টের পদ থাকলেও সবগুলোতে জনবলের অভাব রয়েছে। দ্রুততম সময়ে জনবল সংকট কাটিয়ে উঠলে দেশের অর্থনীতির ভিত তৈরির এসব কারিগরদের স্বাস্থ্য সেবার পথ সুগম হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.