ঘুম, নাওয়া-খাওয়া সবই বাঁধে

বাঁধ ছুঁই ছুঁই পানি। ১০০ মিটার অংশে প্রায়ই ফাটল, গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে। তাতেই এলোমেলো ২০ কৃষকের ঘুম, নাওয়া-খাওয়া। কারণ বাঁধ ভাঙলেই হাওরের সোনালি ফসলের স্বপ্ন শেষ।

বাঁধে সামান্য ফাটল দেখা দিলেই তাঁরা সংস্কারে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। রোদ-বৃষ্টি প্রতিকূল আবহাওয়াতেও থেমে নেই তাঁরা। ফসল রক্ষায় কৃষকদের এই লড়াই চলছে তিন সপ্তাহ ধরে। ঘটনাস্থল সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার খাই হাওরের রাঙ্গামাটি বাঁধ। উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামার পর ২ এপ্রিল

এই বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। খাই হাওরের তিন হাজার ৩০০ হেক্টর জমির বোরো ধান ঝুঁকিতে পড়ে। প্রথমে ৫০-৬০ জন কৃষক বাঁধ রক্ষায় সেখানে পাহারা শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত ২০ জন কৃষক রয়ে গেলেন; সব ফসল না তুলে তাঁরা ঘরে ফিরবেন না। এ জন্য বাঁধে একটি ঝুপড়ি ঘর বানানো হয়েছে। রাখা হয়েছে দুটি নৌকা। ঘর-নৌকাতেই ঘুমান তাঁরা। বিছনা-পাটি বলতে কয়েকটি জীর্ণ কাঁথা-কম্বল। খাওয়া, দাওয়া ও ঘুমের ঠিক না থাকলেও বাঁধ রক্ষার চেষ্টায় তাঁদের সামান্যতম ত্রুটি নেই। তাঁদের সব দৃষ্টি বাঁধে। জনবিচ্ছিন্ন এলাকা হওয়ায় পরিবার-পরিজন মাঝেমধ্যে ওই কৃষকদের খাবার দিচ্ছে। আশপাশের গ্রামের মানুষও তাঁদের খাবার দিচ্ছে।

কৃষকরা জানান, খাই হাওরের তিন হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। এখনো অর্ধেকের বেশি ধান কাটা বাকি।

স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘খাই হাওরের একটি তীরের কয়েকটি বাঁধ চরম ঝুঁকিপূর্ণ। কোনটিতে সরাসরি তীব্র স্রোত আঘাত করছে, কোনটিতে নিচের গহিন গর্ত দেবে নিতে চাইছে। এই কঠিন অবস্থায় আমাদের ডাকে কিছু কৃষক কাজ করছেন রাত-দিন। আমাদের কর্মকর্তারাও তদারকি করছেন। তবে খুশির খবর, কৃষকরা বসে নেই, ধান তোলার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন তাঁরা। ’

ওই ২০ জন কৃষকের একজন উপজেলার সাফারতি গ্রামের কৃষক নজির হোসেন। তিনি বলেন, ‘বান্দো আছি ২০ দিন ধইরা। গেরাম তনি আমরার লাগি বাত লইয়া আইন অনেক মানুষ। যে সময় পরতম নদীত পানি আয় অই সময় আইছলাম। আগে আমরা ৫০-৬০ জন আছলাম। অনে ২০ জন খাজ কররাম। ’

সাপের কোনা গ্রামের কৃষক আফজল মিয়া বলেন, ‘রাইতে দিনে বান্দো আছি। চাইর-পাঁচ স্তরে বাঁশের বেড়া দিছি। মাটির বস্তা, পলিথিন বিছাইয়া দিছি। এক মাইল দূর তনি মাটি আইন্যা বান্দো রাখছি। কান্দা খাছাত কুনু গেরাম নাই। ’ অসহায় কৃষকের কথা ভেবে তাঁরা বাঁধে কাজ করছেন বলে জানান তিনি।

ঠাকুরভোগ গ্রামের কৃষক সুজন মিয়া বলেন, ‘ই বান্দোর মাঝে খাইয়া না-খাইয়া ২০ দিন ধরি আছি। সারা দিন সারা রাইত থাকি। বাড়িত যাই না। যদি বান্দ পালাইয়া যাই তাইলে ভাঙ্গি যিব। মানুষ অনাহারে মরব। মাইনসের মুখের দিকে ছাইয়া আছি। ’

ঠাকুরভোগ গ্রামের এমদাদুল হক বলেন, ‘যদি ই বান্দ টিকাইতাম না পারি তাইলে কৃষক বাঁচতো না। সরকারের ডাকে, মসজিদের মাইকের ডাকে ২০ দিন আগে বান্দে আইছলাম। ধান কাটা শেষ অইলে বাড়িত যাইমু। ’ দূর্বাকান্দা গ্রামের জাকির হোসেন বলেন, ‘বান্দো পইরা রইছি কৃষকরে বাছাইবার লাগি। খানিবনি টেকা পয়সার কথা চিন্তা খরছি না। ’

সলফ গ্রামের কৃষক জুনায়েদ মিয়া বলেন, বাঁধে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের জন্য অনেকে বাঁধে এসে খাবার দিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির লোকজনও অনেক সময় খাবার দিয়ে যায়। কিন্তু তাঁরা বাঁধ ছাড়ছেন না।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ারুজ্জামান বলেন, ‘মহাসিং নদী, লাউয়া নদীসহ উপজেলার প্রতিটি নদী ফুলে উঠেছে। তীর ছুঁই ছুঁই করছে পানি। এই অবস্থায় শুধু রাঙ্গামাটি বা শল্লার বাঁধই নয়, এই নদীর উত্তর তীরের সব বাঁধই ঝুঁকিতে। এখন ঝুঁকিপূর্ণ সময়। টাকা দিয়েও শ্রমিক মিলছে না। আমাদের ডাকে গত ২০ দিন ধরে এখনো বেশ কিছু কৃষক বাঁধে রাত-দিন অবস্থান করছেন। তাঁদের আত্মত্যাগের অর্থ মূল্য দিয়ে হয় না। তবে প্রশাসন তাঁদের দৈনিক ভিত্তিতে সম্মানী দিয়ে যাচ্ছে। ’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-২ শামসুদ্দোহা বলেন, শুধু রাঙ্গামাটি বাঁধই নয়, এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ বর্ধিত গুরমাসহ শনির হাওর, ছায়ার হাওর, নলুয়ার হাওরসহ কয়েকটি বাঁধে এ রকম শ্রমিকরা এখন রাত-দিন কাজ করেন। তাঁদের তদারকি করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রকৌশলীসহ প্রশাসনের লোকজন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.