
জহুরুল ইসলাম, বয়স ৬০। ২৫ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় ভেঙে যায় তাঁর কোমরের হাড়, সঙ্গে বাত ব্যথা। অর্থের অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে না পেরে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি। বাঁকা হয়ে দাঁড়ালেও দুই পায়ের হাঁটু এক জায়গায় লেগে থাকতে থাকতে সেখানে ঘা হয়ে গেছে।
তবু কারো বোঝা হয়ে থাকতে চান না। এখন তাঁর নিত্যসঙ্গী ক্রাচ। এক যুগ ধরে ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটছেন, পিঠে নিয়ে ঝাড়ুর বোঝা।জানা যায়, নন্দীগ্রাম উপজেলার ভাটগ্রাম ইউনিয়নের রায়পুরকুস্তা আদর্শপাড়া গ্রাম থেকে ৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জহুরুল ইসলাম ঝাড়ু বিক্রির জন্য বগুড়া শহরের বিভিন্ন রাস্তাঘাটে ঘোরেন। দুই-তিন দিন ধরে ঝাড়ু বিক্রি করেন। আর এই দুই-তিন দিন মসজিদ ও বিভিন্ন দোকানের বারান্দায় রাত্রিযাপন করেন। ঝাড়ু বিক্রির সেই টাকায় চলে তাঁর সংসার।
জহুরুলের বাবা মৃত ধনাই প্রামাণিক বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চরাঞ্চলের বাসিন্দা। ৩০ বছর আগে যমুনা নদীর ভাঙনে বাড়িঘর হারিয়ে নন্দীগ্রাম উপজেলার রায়পুরকুস্তা আদর্শপাড়া গ্রাম এসে বসবাস শুরু করেন। পেশায় ছিলেন কৃষি শ্রমিক। প্রায় ২৫ বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন জহুরুল ইসলাম। ভেঙে যায় তাঁর কোমরের হাড়।
এরপর আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি, হয়নি কোমর সোজা। শুরু হয় ক্রাচে ভর দিয়ে পথচলা। কাজে কেউ আর না নেওয়ার কারণে একপর্যায়ে প্রায় ১৩ বছর ধরে পথে পথে ঘুরে ঝাঁড়ু বিক্রি করা শুরু করেন।
সরেজমিন উপজেলার রায়পুরকুস্তা আদর্শপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, টিনের ভাঙা বেড়ার বাড়ি। তিনটি ঘর আছে। সেই তিন ঘরে তিন ছেলে ও নাতিরা থাকে। জহুরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রীর ঠাঁই হয় বারান্দায়। সরকারি কোনো ঘর ভাগ্যে জোটেনি। জহুরুলের অভিযোগ, সরকারি ঘর অনেক মানুষকে দিলেও তাঁদের দেওয়া হয়নি। ঝড়বৃষ্টি আর কনকনে শীতে বারান্দায় থাকতে খুব কষ্ট হয়। একটি সরকারি ঘর পেলে সেই কষ্টটুকু থেকে মুক্তি পেতেন। তার যে সাত শতক বাড়ির ভিটা আছে, সেই ভিটার মধ্য দিয়ে গ্রামের মানুষের চলাচলের রাস্তাও দিতে হয়েছে। বিনিময়ে পাননি কোনো টাকা।
কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি জানান, দাম্পত্য জীবনে তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ে আছে। সবাইকে বিয়ে দিয়েছেন। তিন ছেলে বাবার ভিটাতেই থাকেন। তিন সন্তানই দিনমজুর; দিন আনে দিন খায়। খুব কষ্টে জীবন যাপন করছেন তাঁরা। ৫০ বছর বয়সী স্ত্রী নূরজাহান বেগমকে নিয়ে তাঁর সংসার। ঘরে বসে থাকলে খাবার জুটবে না। তাই শরীরের এমন অবস্থায়ও পিঠে করে ঝাড়ুর বোঝা নিয়ে পথে পথে ঘুরে ঝাড়ু বিক্রি করেন।
জহুরুল ইসলাম জানান, প্রতিবন্ধী ভাতা পেলেও সেই টাকা ওধুষ কিনতে শেষ হয়ে যায়। গ্রামে ঝাড়ু বিক্রি হয় না। তাই কষ্ট করে ৪০ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে পিঠে করে ঝাড়ু বিক্রি করতে যান বগুড়া শহরে।
স্ত্রী নুরজাহান জানান, গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঝাঁড়ু তৈরির প্রয়োজনীয় গাছের পাতা সংগ্রহ করি। পরে ঘরে বসে স্বামী-স্ত্রী মিলে ঝাঁড়ু তৈরি করি। সপ্তাহে এক থেকে দুই দিন ১০ থেকে ২০টি ঝাঁড়ু বিক্রি করতে বের হন তিনি। মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার ঝাঁড়ু বিক্রি করেন।
বগুড়া শহরের বিভিন্ন দোকানের মালিক জানান, জহুরুলকে মাঝেমধ্যে পিঠে ঝাড়ু বোঝাই করা অবস্থায় ফেরি করতে দেখা যায়। তিনি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। চলতেও হয় ক্রাচে ভর দিয়ে। এর পরও আত্মনির্ভরশীল জহুরুল। কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা না করে নিজেই আয় করছেন। অনেকে তাঁকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে বিনা প্রয়োজনে তাঁর কাছ থেকে ঝাড়ু কেনেন।
নন্দীগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিফা নুসরাত জানান, তিনি বারান্দায় থাকেন শুনেছি। প্রতিবন্ধী ভাতা পান। তাঁকে অনুদান দেওয়ার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।
Leave a Reply