আবারও সক্রিয় জালনোট তৈরির চক্র

টাকা

রমজান ও ঈদকে ঘিরে চট্টগ্রামে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে জাল টাকার নোট তৈরির অসাধু চক্র। এই চক্র আগে কেবল নগরীতে সক্রিয় থাকলেও এখন ছড়িয়ে পড়ছে উপজেলা পর্যায়েও। সেখানে গড়ে তুলছে জালনোট তৈরির অঘোষিত কারখানা। চক্রের সদস্যরা নানা কৌশলে বাজারে ছাড়ছে জালনোট। ঈদকে কেন্দ্র করে জালনোট তৈরিতে মেতে উঠেছে এ ধরনের বেশ কয়েকটি অপরাধী চক্র। প্রতারণার মাধ্যমে টাকা লুটে নিতে কোটি কোটি টাকার জালনোট তৈরি করে তা বাজারে ছাড়ছে। মেতে উঠেছে রমরমা বাণিজ্যে। ঈদ সামনে রেখে কয়েক কোটি টাকার জালনোট ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। তবে এর আগেই জালনোট তৈরির একটি চক্র শনাক্ত করেছে চট্টগ্রাম র‌্যাব।

র‌্যাব-৭ এর একটি টিম সোমবার কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলায় অভিযান চালিয়ে ১৬ লাখ টাকার জালনোট, জাল টাকা তৈরির সরঞ্জামসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে-কুতুবদিয়ার মনোহরখালী এলাকার শহীদুল্লাহর ছেলে সাইফুদ্দীন আহাম্মদ ওরফে মিজান (২৫), মিসবাহ্ উদ্দিন (৩২), জিয়াউদ্দিন (২০) ও কৈয়ারবিল এলাকার ওমর আলীর ছেলে সাইফুল ইসলাম (২৪)। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে জালনোট প্রস্তুতের কাজে ব্যবহৃত থিংকপ্যাড, ল্যাপটপ, নোটপ্যাড, এলইডি মনিটর, কালার প্রিন্টার, ফটোকপি প্রিন্টারসহ বেশ কিছু সরঞ্জাম।

র‌্যাবের সঙ্গে কথা বলে ও খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, জাল টাকার নোট তৈরি ও এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত চক্রের প্রত্যেকেই পেশাদার। তারা একদিকে জাল টাকার নোট তৈরি করে, অন্যদিকে জাল টাকার ব্যবসাও করে। চক্রের অনেক সদস্য এ ব্যবসার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। স্বল্প বিনিয়োগে বেশি টাকা আয় করা যায় বলেই তারা নানা ঝুট-ঝামেলার পরও এ পেশা ছাড়ছে না। এক সময় নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে জাল টাকা তৈরি করত চক্রের সদস্যরা। তবে এক জায়গায় বেশি দিন তারা থাকে না। ধরা পড়ার ভয়ে ঘন ঘন বাসা বদলায়। চলে যায় এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়। সেখানেই গড়ে তোলে জাল টাকা তৈরির কারখানা। নগরী ছেড়ে জেলা শহরেও তারা ‘কারখানা স্থানান্তর’ ও জাল টাকার ব্যবসার বিস্তার ঘটাচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। চক্রে রয়েছে নারী সদস্যও। কখনো গৃহিণী, কখনো কলেজছাত্রী সেজে জাল টাকা বহন করে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে তারা। আবার তাদের মাধ্যমেই পণ্য কেনাকাটা করে মার্কেটে জাল টাকার বিস্তার ঘটানো। সেজন্য তাদের দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের কমিশন। ধরা পড়লেও তাদের আইনি সহায়তা দেয় সিন্ডিকেটের হোতারা।

র‌্যাব-৭ জানায়, এক সময় চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থানে বাসা ভাড়া নিয়ে জাল টাকা তৈরি করা হলেও বর্তমানে সিন্ডিকেট সদস্যরা শহরের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। কিছুদিন ধরে র‌্যাবের কাছে অভিযোগ আসতে থাকে যে একটি চক্র দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলকে বেছে নেয় বাংলাদেশি জাল টাকা তৈরি করার জন্য। দুর্গম এলাকায় টাকা তৈরি করে তা বাহক ও চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে শহরে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে এসব জালনোট। রোববার গভীর রাতে কুতুবদিয়ার উপজেলা পরিষদ গেটের সামনের একটি ভবনের নিচতলার একটি কম্পিউটার দোকানে অভিযান চালায়। ওই ভবন থেকে গ্রেফতার করা হয় চারজনকে। তাদের কাছ থেকে ১ হাজার টাকার ১৬ লাখ টাকা মূল্য মানের জালনোট উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাবে গ্রেফতারকৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সাইফুদ্দীন আহাম্মদ এই অবৈধ জালনোট সিন্ডিকেটের মূল হোতা। টাকা তৈরির সরঞ্জামের সবকিছুই তিনি বিনিয়োগ করেছেন। সাইফুল ইসলাম কম্পিউটার বা ল্যাপটপে জাল টাকাগুলো প্রস্তুত করে কালার প্রিন্টারে প্রিন্ট করত। আর মিসবাহ্ উদ্দিন জাল টাকাগুলো দেশের বিভিন্ন জেলায় আসল টাকা হিসাবে তাদের চক্রের নির্ধারিত লোকের মাধ্যমে চালানোর ব্যবস্থা করত। মো. জিয়াউদ্দিন জাল টাকা তৈরির সময়ে ওই দোকানের দরজায় পাহারায় নিয়োজিত থাকত। টাকা ছাপানোর পর তাদের চক্রের নির্ধারিত লোকের মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে জাল টাকাগুলো সুকৌশলে চালানো হতো বলে জানান র‌্যাবের এ কর্মকর্তা।

সূত্র জানায়, ১ লাখ টাকার জালনোট তৈরিতে খরচ হয় মাত্র ৭ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। তারা পাইকারি বিক্রেতার কাছে ১ লাখ টাকা বিক্রি করে ১৪-১৫ হাজার টাকায়। পাইকারি বিক্রেতা ১ম খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে ২০-২৫ হাজার টাকায়, ১ম খুচরা বিক্রেতা ২য় খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে ৪০-৫০ হাজার টাকায় এবং ২য় খুচরা বিক্রেতা মাঠপর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ টাকা তুলে নেয়। অর্থাৎ লাখ টাকার বিপরীতে ৮০-৯০ হাজার টাকা তুলে নেয়। আগে ১০০, ২০০ কিংবা ৫০০ টাকার নোট তৈরি হলেও এখন সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকার নোট তৈরিতেই স্বাচ্ছন্দ বেশি তাদের। এতে খরচও কম লাভও বেশি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জালনোট তৈরির জন্য প্রথমে টিস্যু কাগজের এক পার্শ্বে বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি স্ক্রিনের নিচে রেখে গাম দিয়ে ছাপ দিত। এরপর ১০০০ লেখা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রামের ছাপ দিত। অতঃপর অপর একটি টিস্যু পেপার নিয়ে তার সঙ্গে ফয়েল পেপার থেকে টাকার পরিমাপ অনুযায়ী নিরাপত্তা সুতা কেটে তাতে লাগিয়ে সেই টিস্যুটি ইতঃপূর্বে বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি জলছাপ দেওয়া টিস্যু পেপারের সঙ্গে গাম দিয়ে সংযুক্ত করে দিত। আর এভাবেই মুহূর্তেই হাজার টাকার নোট প্রিন্ট হয়ে যেত।

র‌্যাব-৭ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. নুরুল আবছার যুগান্তরকে জানান, রমজান ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্য করে টাকার প্রবাহ বাড়ে। কেনাকাটা বৃদ্ধি পায়। সবাই ব্যস্ত থাকে। এ সুযোগটি জালনোট তৈরির সঙ্গে জড়িত চক্র লুফে নিতে চায়। প্রতিবছরই চক্রটি এ সময়ে সক্রিয় হয়। সম্প্রতি সক্রিয় হওয়া একটি চক্রকে র‌্যাব গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। তাদের কাছ থেকে ১৬ লাখ টাকার জালনোট ও নোট তৈরির সরঞ্জামও উদ্ধার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জড়িতদের বিরুদ্ধে। সূত্র; যুগান্তর

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.