
যুগে যুগে কবিরা ভাষা থেকে শুরু করে দেশ, মাটি, মানুষ, এমনকি দেশের ‘জন্মবৃত্তান্ত’ নিয়ে আবেগঘন পঙ্ক্তি রচনা করেছেন। সেই ঐতিহ্য দেশ, কাল বা ভূখ- নির্বিশেষে বিশ্বজনীন চরিত্র অর্জন করেছে। ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশ এবং বাঙালি লেখকরা।
এর অন্তর্নিহিত চেতনার মর্মবস্তুটি হলো স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা এবং তা ব্যক্তি থেকে সমষ্টিগত পর্যায়ে বিস্তৃত- ইতিহাস তার পাতায় এ সত্যটি লিখে রেখেছে যুগ থেকে যুগান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই চেতনার বিস্তার ও পরিবর্তন নানা তাত্ত্বিক মতাদর্শের মধ্য দিয়ে যেমন জাতিগত স্বাধীনতা, সম্প্রদায়গত স্বাধিকার এবং ব্যক্তিক পর্যায়ে ব্যক্তিস্বাধীনতার নানা পর্যায়ে- যেমন বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা এবং যা প্রকাশের স্বাধীনতায় পর্যবসিত। তার নানা রূপ যেমন ব্যক্তিমাধ্যম, গণমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম ইত্যাদি।
স্বাধীনতা একটি জাদুকরী শব্দ। এর জন্য আত্মদানের আবেগ অপরিসীম এবং তা যথারীতি ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে প্রসারিত। একসময় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ তাদের বুদ্ধি, শক্তি, চাতুর্য ও বিচক্ষণতায় বিশ্বের এপিট-ওপিঠ জয় করে ফেলেছিল। একদিকে উত্তর আমেরিকা, অন্যদিকে ভারতীয় উপমহাদেশ- মাঝখানে বহু ভূখ-।
উপনিবেশবাদ থেকে সাম্রাজ্যবাদ প্রত্যেকেরই মূল চরিত্র শাসনের পাশাপাশি শোষণ। আর তার বিরুদ্ধে ক্রমজাগ্রত স্বাধীনতার চেতনা। একই বর্ণ, একই জাতিসত্তার হয়েও সেই চেতনার টানে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ- মূল চেতনা, এ দেশ আমার, এ মাটি আমার, এর ফসলের অধিকার পুরোপুরি আমার। এখানে দূরদেশি কেন প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব বিস্তার করবে?
না, তা হতে পারে না। নানা বিন্যাসে সব স্বাধীনতা যুদ্ধের মর্মকথা, মর্মবস্তু ওই একই সত্যের প্রতিফলন। অর্থাৎ নানা স্তরে, নানা শ্রেণিতে ব্যক্তিসত্তাসহ গণতান্ত্রিক অধিকারের সর্বমাত্রিক প্রতিষ্ঠা। এমন একটি আদর্শের ওপর ভর করে সর্বদেশীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ- জয়-পরাজয়ের সম্ভাবনা নিয়ে। বলাবাহুল্য, অনেক আত্মদান, অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জন সে ভূরাজনৈতিক স্বাধীনতা। বিপুল আত্মদানেও প্রাপ্তির গর্ব অনেক।
কিন্তু কেউ কি ভেবে দেখেছেন ভূরাজনৈতিক স্বাধীনতা চেতনার উল্টো পিঠ, নেতিবাচক দিকের কথা, এর সহমর্মিতার বিপরীত চেতনার কথা, গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্রকে বিসর্জন দেওয়ার মতো ঘটনাবলির কথা। বিশ্বজুড়ে উদাহরণ ছড়ানো। দু-একটি সূত্রের উল্লেখই যথেষ্ট। তাতেই বোঝা যাবে আলোর নিচে আঁধারের অস্তিত্ব।
আমেরিকার ভূরাজনৈতিক স্বাধীনতার উদাহরণই ধরা যাক। এর নায়কদের অধীনে তখন চরম অমানবিক দাস প্রথা, চরম নির্মমতা বিরাজ করছে, সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিসর্জিত, বর্ণভেদে ব্যক্তিস্বাধীনতা লুণ্ঠিত, এমনকি তাদের জীবনের মূল্য কানাকড়িরও নয়। তবু ব্যতিক্রমই সত্য। স্বাধীনতার মূল্য বুঝিয়ে দিতে অন্তত একজন প্রেসিডেন্ট গণতন্ত্রের তাত্ত্বিক সত্য এবং দাসদের জীবনের মূল্য প্রতিষ্ঠা করে গেলেন নিজের জীবনের বিনিময়ে। তিনি আব্রাহাম লিংকন। অন্য কীর্তিমানরা পেছনে পড়ে রইলেন আদর্শিক বিচারে।
কিন্তু সে গণতন্ত্রের শপথবাণী, তার মূল্যবোধের বাস্তবায়ন কি ঘটেছে উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানপ্রযুক্তির পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সামাজিক সর্বস্তরে? কিছুটা ঘটেছে সাধারণ মাত্রায়। যেমন অভিভাবক সন্তানকে দৈহিক পীড়নে শাসন করতে এলে সে পুলিশ ডাকার অধিকার রাখে। বলতে পারে এ শরীর আমার, এখানে হাত দেওয়ার অধিকার অন্য কারও নেই। আবার এর বিপরীতটাও বাস্তব- খেলনা পিস্তল হাতে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে পুলিশ খুন করে ফেলেও বিচারে মুক্তি পেয়ে যায়। অনুরূপ বা তার চেয়েও নিকৃষ্ট ঘটনা গণতন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণভেদে নিয়মতান্ত্রিক সত্যের মতোই ঘটে থাকে। বিচার সেখানে অন্ধ বা তার দুচোখ বাঁধা। উদাহরণ একা যুক্তরাষ্ট্র নয়। অন্য দুটো উদাহরণ আমি প্রায়ই উল্লেখ করে থাকি।
যে প্রবল আত্মদানে ব্রিটিশ উপনিবেশ কেনিয়ার মাও মাও বিদ্রোহ সফল হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, সেই যুদ্ধের নায়ক জম্মু কেনিয়াট্টা ক্ষমতায় আসীন হয়ে কী অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। সঙ্গী দুর্নীতি। অনুরূপ আত্মদানের ফরাসি উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তি তথা স্বাধীনতা অর্জনের পর ক্ষমতা নিয়ে কী অবিশ্বাস্য লড়াইটা না চলল আলজেরিয়ায়।
দ্রুই সামরিক, আধা সামরিক শাসন এবং নিয়মতান্ত্রিক শাসনের নামে সেখানে স্বৈরশাসনের আধিপত্য এবং দলীয় বিবাদে গণতন্ত্র নির্বাসিত।
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনে স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবীদের আত্মদানের ইতিহাস দীর্ঘ, অন্যদের কারাজীবনের দৈর্ঘ্যও কম নয়, যদিও শেষ পর্যন্ত আত্মঘাতী হাঙ্গামার জেরে আপসের স্বাধীনতা। কিন্তু কাগজে-কলমে হলেও বাস্তবে গণতন্ত্র ও সেক্যুলার চেতনা কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম দ্বিভাজনে? যে জন্য রাজনীতির একাংশে সেøাগান উঠে ছিল : ‘ইয়ে আজাদি (স্বাধীনতা) ঝুটা হ্যায়।’
পাকিস্তান পূর্ববঙ্গে অনিয়মতন্ত্র ও দুঃশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। পূর্ব-পশ্চিমে বিপুল বহুমাত্রিক বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল। গণতন্ত্র নির্বাসনে। প্রতিবাদের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধশেষে স্বাধীন বাংলাদেশ। অনেক আশা-আকাক্সক্ষা নতুন মানচিত্র ঘিরে। নতুন পতাকা নিয়ে প্রচ- আবেচগ বাঙালিমাত্রেরই এবং তা সর্বস্তরে সর্বশ্রেণিতে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। পরাশক্তির বিরোধিতা। প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই সঙ্গে সমাজতন্ত্রী চীনও বিরোধী দলে এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্র। অর্থনীতি বিপর্যস্ত। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে কিছু রাষ্ট্রিক অসহযোগিতার মুখে সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বাস্তবায়ন গুরুত্ব পায়নি। যাকে বলে সমাজ বদল, সে তো অনেক দূরের কথা। বরং দুর্বোধ্য কারণে একাত্তরের সহমর্মিতার বোধ নির্বাসিত প্রায়।
যথারীতি রাজনৈতিক নৈরাজ্য। একাত্তরের ঐক্যও একই পথে। ফলে ১৯৭৫-এর শোকাবহ ঘটনা এবং পালা করে দুই জেনারেলের হাতে শাসন সামরিক ও স্বৈরশাসনই বলা চলে। স্বাধীনতার পূর্বোক্ত নেতিবাচক দিক দেশ-কালভেদে ভিন্ন চরিত্রে প্রকাশ। তার চেয়েও বড় অঘটন স্বাধীনতার ঐক্য বিসর্জিত, জাতি রাজনৈতিক দিক বিচারে বিভাজিত।
আর পূর্বোক্ত উদাহরণগুলোর মতো এখানেও শাসনব্যবস্থায় নৈরাজ্য-দুর্নীতি তার ব্যাপক সঙ্গী। সমাজও অভাবিত মাত্রায় দুর্নীতিগ্রস্ত, অবক্ষয়ে জীর্ণ। সামাজিক সুবিচার, ন্যায়নীতি প্রত্যাশার বাইরে। সমাজের সেক্যুলার চরিত্রও প্রশ্নবিদ্ধ, জীবনাচারে সাংবিধানিক সৎ মূল্যবোধগুলো অবহেলিত। স্বাধীনতা সমাজকে যে সুযোগ-সুবিধাগুলো দিয়েছে, সেসবের অধিকাংশই চর্চার বাইরে।
শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন, সংসদীয় ব্যবস্থার প্রবর্তনের পরও দেশাত্মবোধভিত্তিক রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠেনি। দেশপ্রেম ও দেশস্বার্থ গুরুত্বহীন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন একমুখী, তা একাত্তরের আদর্শিক চেতনাভিত্তিক নয়। হলে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সহিংসতার অভাবিত বৃদ্ধি ঘটত না, অবিশ্বাস্যমাত্রায় নারী নির্যাতনের নৃশংসতা বৃদ্ধি পেত না, দুর্নীতি সর্বস্তরে ব্যাপক মাত্রায় দেখা দিত না।
নীতি-নৈতিকতাকে অতিক্রম করে চলেছে অনৈতিকতার নানামাত্রিক চরিত্র। ব্যতিক্রম নয় শিক্ষাঙ্গনে। শিক্ষায়তনে ছাত্র-শিক্ষকদের অংশবিশেষ শুদ্ধাচার অন্তর্নিহিত। ছাত্র রাজনীতির একাংশ সহিংসতায় লিপ্ত এবং দূষিত। কিছু সাম্প্রতিক ঘটনা তার প্রমাণ বহন করছে। শিক্ষকদের একাংশে নীতিবোধের অভাব, ব্যক্তিগত স্বার্থপরতার প্রভাবই প্রধান।
স্বভাবত এসবের প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। মাদক বাণিজ্য ও মাদকাসক্তি ভয়ানক শক্তি নিয়ে, নানা প্রশ্রয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, যা সমাজের জন্য বলতে হয় অশনিসংকেত। সমাজে সহিংসতার প্রাধান্য। পূর্বোক্ত কথার পুনরোক্তিতে বলতে হয় জীবনের দাম কানাকড়ি। একদিকে শ্রেণিবিশেষে বিপুল অর্থনৈতিক উন্নতি, অন্যদিকে সমাজে ব্যাপক দুর্নীতি। সামাজিক বৈষম্য, শ্রেণিগত বৈষম্য কতটুকু কমেছে?
আগেও বলেছি, আবারও বলছি স্বাধীনতার মূল্যায়নের জন্য সমাজে দুর্নীতির জরিপ অত্যাবশ্যক। বুঝে নেওয়া দরকার কোন শ্রেণিতে দুর্নীতির হার কতটা? এ ক্ষেত্রে নিম্নবর্গীয়দেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ তাদের অংশবিশেষও তাদের শ্রেণি-চরিত্রের সততা হারিয়ে ‘লুম্পেন’ চরিত্র অর্জন করেছে এবং উচ্চশ্রেণির স্বার্থ বৃদ্ধি করে চলেছে। পরিবহন খাত একটি বড় উদাহরণ। আশ্চর্য শিক্ষা খাতও পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত নয়।
অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা কি এমন এক কীটদষ্ট সমাজ উপহার দিয়েছে? দোষ বা দায় কি স্বাধীনতার? সেটাও প্রশ্ন। সাম্প্রতিক দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে যে চালচিত্র প্রকাশ পেতে শুরু করেছে, তা শ্রেণি তো বটেই, নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে। দৈনিকের পাতাগুলোয় নিত্যখবরে এমনই চিত্রের প্রকাশ। এমন স্বাধীনতা কি প্রত্যাশিত ছিল? বড় দরকার সমাজটাকে সর্বাংশে ধুয়ে-মুছে সাফসুতরো করে তোলা। এর কোনো বিকল্প নেই, এই সঙ্গে প্রয়োজন স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষার।
আহমদ রফিক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক
Leave a Reply