সমস্যা আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নির্ধারণ করে দেয়া ‘নর্মস’

লামিয়া ইসলাম

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ শুধুমাত্র নারীদের বৈশিষ্ট্য আর কাজ নির্ধারন করে দেয়না। বরং নারীর পাশাপাশি, ট্রান্স এমনকি খোদ পুরুষদের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে দেয়। বুলির স্বীকার হতে হয় পুরুষদেরও।

পুরুষরাই পুরুষদের দ্বারা ব্যাপক অপমানের স্বীকার হয়। ধরা যাক, দাড়ি প্রসঙ্গে। টিনেজে অনেক বাচ্চা ছেলেদেরই একটু দেরী করে দাড়ি গজায়। এই দেরীর সময়টা তাকে হতে হয় নানা ভাবে অপদস্ত। অন্য ছেলেদের সাথে মারামারি বা ঝগড়া হলেও তাকে শুনতে হয় “আরে তুই ত একটা মাইয়া,তোর ত গোঁফ দাড়ি ই উঠে নাই” বলে বিদ্রুপের হাসি। এই খানে “মাইয়া” শব্দটা বলার মাধ্যমে তাকে দুর্বল, হীন, নিচ, অক্ষম ইত্যাদি নেগেটিভ ভাইবই দেওয়া হয়। নারী মানেই যেন অধম। অথচ আমার মনে হয় না কোনো মেয়ে কোনো ছেলেকে দাড়ি বা লোম নিয়ে এরকম বুলি করে বা জাজ করে। একই সাথে ছেলেদের কাঁদতে নাই, ছেলেরা হাজারো মাইর খাওয়ার পর ও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, ছেলেদেরকেই নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে পরিবারের হাল ধরতে হবে ইত্যাদি চাপিয়ে দেওয়া হয়। এই চাপিয়ে দেওয়াটা অধিকাংশ সময়েই দেখা যায় পুরুষদের হাত ধরেই আসে। নারীরা মমতা দিয়ে তাদের বুঝতে ও বোঝাতে চায়। পুরুষরা কাঁদলে তাতে সহানুভূতি জানাতে চায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো পুরুষরাই এই বিষয়গুলোতে অসহায় পুরুষটার প্রতি সবচেয়ে খারাপ ব্যবহারটা করে। তাদের সমাজ নির্ধারিত “ম্যান ইগো” তে আঘাত লাগে যেন। তাদের এতোবছরের গড়ে তোলা “পুরুষরা সিংহ ‘ নারীরা দুর্বল”- এটা যে কতোবড় মিথ্যা তা যেন মুখোশের আড়াল থেকে বের হয়ে আসতে চায়। তখন কর্তৃত্ব পরায়ণ পুরুষের বুক কাঁপে এই ভয়ে এইনা জোর করে নেওয়া ক্ষমতা গেল হাত থেকে।

“ম্যান ইগো” তে যেমন ছেলেরাই ছেলেদের দ্বারা অধিকাংশ সময়ে আক্রমনের স্বীকার হয়। তেমনি নারীও নারীদের দ্বারা প্রচুর জাজমেন্ট এর স্বীকার হয়। নারীর ড্রেস, সাজ,  স্বামী, সন্তান ইত্যাদি নিয়ে অন্য নারীর থেকেই নারী স্বাধীনতায় সর্বোচ্চ বাধাটাও পেয়ে থাকে এমন ও প্রচুর হয়।

সমস্যা আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নির্ধারণ করে দেওয়া নর্মস।

এমন আরেকটি জনপ্রিয় নর্মস হলো সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ছেলেরাই মেয়েদের পিছনে ঘুরবে, ছেলেরাই মেয়েদের এপ্রোচ করবে এবং ছেলেরাই মেয়েদের কেয়ারিং করবে, যাবতীয় দায়িত্ব নিবে এবং বলাই বাহুল্য প্রয়োজনে ” শাসন” ও করবে। যেন মেয়ে মাত্রই অবজেক্ট। তার দায়িত্ব নেওয়ার কিছু নেই, সে শুধু দায়িত্ব পালনের জন্য জন্ম। খুবই মিথ্যা কথা কেয়ারিং শুধু মেয়েদের ভালো লাগে। বরং কেয়ারিং সকলের ই ভালো লাগে। প্রতিটি সম্পর্কেই উভয়েরই উভয়ের প্রতি যত্ন ও সম্মান থাকা বাঞ্চনীয়। ভালো লাগা উভয়ের ই হতে পারে। কারণ উভয়েই মানুষ। যে কেউ ই আগে বলতে পারে বা যে কেউই যে কাউকে যত্ন নিতে পারে। এখন সময় এসেছে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ না করে সমান চোখে দেখার। মেয়েদের ও চুল ছোট রাখতে ভালো লাগতে পারে আবার ছেলের’ চুল বড়ো রাখতে পছন্দ করতে পারে। প্রতিটি বিষয়ই ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত রুচিবোধ। নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, লালন, বব মার্লে, আইনস্টাইন সহ হাজারো মনীষী, গায়ক, বিজ্ঞানী, দার্শনিকদের চুল বড়ো ছিলো আবার হাজারো সাকসেসফুল নারীর চুল ছোট। সুতরাং যেসব পার্থক্য প্রাকৃতিক সেসব তফাতের বাইরে সমাজ নির্ধারিত যে জেন্ডার নর্মস রয়েছে সেসব থাকা মানেই অন্যের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। হাতের পুতুল দাস বানানোর মানসিকতা। যার ফলে শোষিত হয় খোদ পুরুষ, নারী, ট্রান্স, ননবাইনারি সবাই ই। সুতরাং এসব বৈষম্য বাতিল করা এখন সময়ের দাবী।

লেখক, নারীবাদী এক্টিভিস্ট

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.