বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ঢাকা ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

আনন্দমোহন বসু ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী। বাংলাদেশ ও ভারতে রয়েছে তার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষালয়। তার নামেই ময়মনসিংহের বিখ্যাত আনন্দমোহন সরকারি কলেজ। শিক্ষাবিস্তারে তার ভূমিকা চিরস্মরণীয়। শিক্ষানগরী হিসেবে পরিচিত ময়মনসিংহ শহরে আনন্দমোহন বসুর পৈতৃক বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ‘সিটি কলেজিয়েট স্কুল’ ১৩৯ বছরের পুরোনো। শহরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে এটি অনন্য। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষালয়টি এখন ঢাকা পড়েছে বিপণিবিতানের আড়ালে। দেখলে মনে হবে, বিদ্যার আলো জ্বালানোর চেয়ে মার্কেট পরিচালনা করাই যেন মূল উদ্দেশ্য।
শুধু এ প্রতিষ্ঠানটিই নয়, ময়মনসিংহ নগরীর ঐতিহ্যবাহী আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিত্রও একই। এগুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি নাগরিকদের।

ময়মনসিংহ নগরীর রামবাবু রোডে আনন্দমোহন বসুর পৈতৃক বাড়ি। বাড়িটিতে ১৮৮৩ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে একটি শিক্ষালয়। শুরুতে আনন্দমোহন ইনস্টিটিউশন নাম দিয়ে প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। এটিতে প্রথম থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ চালু হয়। কিন্তু এটি ডিগ্রি পর্যন্ত উত্তীর্ণ করা হলে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি শাখা স্থানান্তর হয় কাঁচিঝুলিতে- বর্তমান আনন্দমোহন কলেজে। স্কুল আলাদা রাখতে গিয়ে তৎকালীন নিয়ম অনুযায়ী একই শহরে এক ব্যক্তির নামে দুটি প্রতিষ্ঠান থাকার সুযোগ ছিল না। ফলে আনন্দমোহন বসুর কলকাতার সিটি কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শাখা হিসেবে ১৯০১ সালে ময়মনসিংহে নিজ ভিটার শিক্ষালয়টির নাম দেওয়া হয় সিটি কলেজিয়েট স্কুল। তার মৃত্যুর পর সিটি কলেজিয়েট স্কুল চত্বরেই আনন্দমোহন বসুর দেহভস্মের স্মৃতিমঠ করা হয়, যা এখনও আছে।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে, শিক্ষক এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি এখন জৌলুস হারিয়েছে। অথচ সিটি কলেজিয়েট স্কুলের ঠিক বিপরীতেই বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি সাফল্যের সৌরভ ছড়াচ্ছে। একসময় ময়মনসিংহ শহরে হাতেগোনা কয়েকটি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম ছিল সিটি কলেজিয়েট স্কুল। শিক্ষার্থীদের কোলাহলে মুখর থাকত। শিক্ষার্থী ঠাঁই দেওয়ার সংকুলান হতো না। কিন্তু এখন চিত্র উল্টো। শুরুতে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এটিতে পাঠদান হলেও বর্তমানে তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ কার্যক্রম চালু আছে। বর্তমানে কাগজপত্রে শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৩৫৫। প্রাথমিক সেকশনে শিক্ষার্থী খুবই কম। প্রতিষ্ঠানটির সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেও বোঝার উপায় নেই, এখানে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। পুরোনো তোরণ খসে পড়ছে। ভেতরেও প্রাচীন ভবনগুলো ভেঙে নিঃশেষ হয়ে গেছে। নতুন ভবন করার জন্য কিছুদিন আগে একটি পুরোনো জীর্ণ ভবন ভাঙা হয়েছে। বিদ্যালয়টি ঘিরে রয়েছে বিপণিবিতান। মাঠে নির্মাণসামগ্রী আর ঝোপঝাড়ে শিক্ষার পরিবেশ প্রতিকূল।

‘কীভাবে বিদ্যালয়টি মার্কেটে পরিণত হলো’- জানতে চাইলে শিক্ষকদের কয়েকজন জানান, ১৯৯৩ সালে তৎকালীন পরিচালনা কমিটি প্রতিষ্ঠানটির সামনে মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। তখন বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। দোকানগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল কারণ, তখন স্কুলের সামনে হকার বসত এবং রাতে শিয়াল পরিবেশ নষ্ট করত। সে কারণে কমিটির লোকজন সিদ্ধান্ত নেয় মার্কেট নির্মাণের। কিন্তু এখন দোকানপাটে আড়াল হয়ে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিই। পরে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে পাঁচ বছর আগে আদালতে একটি মামলা করা হয়। সেই মামলা এখনও চলমান থাকায় দোকান উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে মাত্র ৯ জন শিক্ষক দিয়ে কোনোরকমে পাঠ কার্যক্রম চলছে। প্রতিষ্ঠানটির বেহাল অবস্থার পেছনে নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও অব্যবস্থাপনার কথা বলেছেন সবাই।
সিটি কলেজিয়েট স্কুলে ১৯৯৬ সালে দপ্তরি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন মো. কামরুজ্জামান। তিনি সমকালকে বলেন, তিনি যখন বিদ্যালয়টিতে যোগ দিয়েছিলেন, তখন শিক্ষার্থী ছিল হাজারখানেক। কিন্তু এখন শিক্ষার্থী নেই আগের মতো।

সিটি কলেজিয়েট স্কুলের এসএসসি ১৯৮১ ব্যাচের শিক্ষার্থী অ্যাডভোকেট শিব্বির আহমেদ লিটন আক্ষেপ করে বলেন, প্রাণের বিদ্যালয়টি এখন সিটি মার্কেটে পরিণত হয়েছে। অদক্ষ পরিচালনার কারণে বিদ্যালয়টির এই দৈন্য। স্কুলটি ধীরে ধীরে উইপোকার মতো খেয়ে ফেলা হয়েছে।
নগরীর স্টেশন রোডে আরেকটি খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘ময়মনসিংহ উচ্চ বিদ্যালয়’। এর সামনেও রয়েছে মার্কেট। নিচতলায় দোকান আর দ্বিতীয় তলায় চলে পাঠ কার্যক্রম। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়টিও অনেক ঐতিহ্যের। কিন্তু দোকানপাটের আড়ালে পড়েছে এ প্রতিষ্ঠানটিও।
নগরীর গাঙ্গিনাপাড় হকার্স মার্কেটের পাশেই প্রবাহ বিদ্যানিকেতন। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের একটি। কিন্তু বিপণির আড়ালে ঢাকা পড়েছে প্রতিষ্ঠান। নেই জৌলুসও। বিদ্যালয়টির সামনে গিয়ে বোঝার কোনোই উপায় নেই, এটি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রবাহ বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষককে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এমনই আরেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘ময়মনসিংহ মহাবিদ্যালয়’। নতুন বাজারসংলগ্ন এই বিদ্যালয়টির সামনেই দোকানপাটে ঘেরা। রাস্তা থেকে কেউ বুঝতেই পারবেন না, ভেতরে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে জারি হওয়া এক পত্রে দেশের সব স্কুল ও কলেজের গেটের সামনে কোনো স্থায়ী বা অস্থায়ী দোকান না রাখার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও বিভিন্ন সময়ে পত্র দিয়ে এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সতর্ক করা হয়েছে। স্থায়ী ও অস্থায়ী দোকানপাট শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করে শিক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অতীতে একাধিক সভাও হয়েছে।

‘জনউদ্যোগ’ ময়মনসিংহের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, সবকিছুই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা শুরু হয়েছে। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর রাস্তার পাশে খালি জায়গা আছে, সে জায়গা ভাড়া দিয়ে বাড়তি ইনকাম করা হয়। মৌলিক প্রশ্ন দাঁড়ায়, প্রত্যেক শিক্ষক তো এমপিওভুক্ত, বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন দপ্তর থেকে বরাদ্দও দেওয়া হয়। তার পরও দোকান ভাড়া দিয়ে বিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিদ্যালয়গুলো দূর থেকে দেখেই সাধারণ নাগরিক যেন বুঝতে পারেন, সেই বিদ্যালয়। সেটি যেন স্বমহিমায় থাকে- এমনটি প্রত্যাশা।

এসব বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, পরিচালনা কমিটির লোকজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে দোকানপাট পরিচালনা করতেই বেশি উৎসাহী। এসব বন্ধ করতে কমিটিই বড় বাধা। ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী সিটি কলেজিয়েট স্কুল, প্রবাহ বিদ্যানিকেতন আর মৃত্যুঞ্জয়ী স্কুলে এ সমস্যা সবচেয়ে বেশি। মৃত্যুঞ্জয়ী স্কুলে বর্তমান রাষ্ট্রপতিও ছাত্র ছিলেন। কত ঐতিহ্যের সব স্কুল! আমরা বারবার সতর্ক করার পরও তেমন কাজ হয়নি। কেবল প্রবাহ বিদ্যানিকেতনটা কিছুটা ঠিক করা গেছে। তিনি বলেন, নগরবাসীর সচেতনতা এ ক্ষেত্রে খুব দরকার।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.