শব্দদূষণে গতি কমছে শ্রবণে

শব্দদূষণের কারণে শ্রবণ শক্তি কমে যাওয়াসহ মানুষের নানা ধরণের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। তবে এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে স্কুলগামী শিশুদের উপর। তাই হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে হর্ন না বাজাতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়াসহ শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা বাস্তবায়নে ১০ দফা সুপারিশ জানিয়েছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এবং ইকিউএমএস কনসালটিং লিমিটেড।

বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক শ্রবণ দিবস উপলক্ষে প্রতিষ্ঠান দুটি অনলাইনে আয়োজিত ‘প্রাণ প্রকৃতির উপর শব্দদূষণের প্রভাব ও প্রতিকার’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়।

এতে সুপারিশগুলো তুলে ধরেন ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।

ওয়েবিনারে বক্তারা সবাইকে এক ছাদের নিচে এসে সম্মিলিতভাবে এই শব্দদূষণ রোধে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। সব স্তরের মানুষকে সংযুক্ত করারও তাগিদ দিয়েছেন তারা।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যত সুপারিশ:

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সংগঠন দুটির অন্যান্য সুপারিশগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের আওতায় পরিবেশ ক্যাডার ও পরিবেশ পুলিশ নিয়োগ দেওয়া; বিধিমালা সংজ্ঞা অনুযায়ী চিহ্নিত জোনসমূহে (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) সাইনপোস্ট উপস্থাপন করা ও তা মানার বিষয়ে নিয়মিত মনিটরিং করা; ৯৯৯-এ কল সার্ভিসের পাশাপাশি অনলাইনে ই-মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দণ্ড প্রদান করা; পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ, সিটি কর্পোরেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য প্রশাসনিক দপ্তরের সমন্বয় করা; হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি বন্ধ নিশ্চিত করা, স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন না করা, হর্ন বাজানোর শাস্তি বৃদ্ধি, চালকদের শব্দ সচেতনতা যাচাই করে লাইসেন্স প্রদান করা ও শব্দের মাত্রা অনুযায়ী যানবাহনের ছাড়পত্র দেওয়া; শব্দের মাত্রা হ্রাসের পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া নির্মাণ প্রকল্প ও শিল্প-কারখানা স্থাপনে ছাড়পত্র প্রদান না করা; উচ্চ শব্দ এলাকায় ইয়ার মাফসহ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবহার করা; ছাদ, বারান্দা, খোলা জায়গায় গাছ লাগানো (গাছ শব্দ শোষণ করে) ও সড়কের পাশে গাছ লাগিয়ে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করা এবং সন্ধ্যার পর ছাদ ও কমিউনিটি হলে গান-বাজনা না করা; ব্লেন্ডার, প্রেশার কুকার ও ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার না করা, ড্রিল ও গ্রাইন্ডিং মেশিন এর ব্যবহার সীমিত করা।

ওয়েবিনারে বাংলাদেশ প্রাণীবিজ্ঞান সমিতির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. গুলশান আরা লতিফা বলেন, শব্দদূষণের ফলে জলজপ্রাণীর ক্ষতি হয়, একেক ধরনের প্রাণীর শ্রাব্যতা সীমা একেক রকম। ফলে মাত্রাতিরিক্ত শব্দের ফলে তারা দিশেহারা হয়ে যায়। সকলকে এক ছাদের নিচে এসে সম্বলিত ভাবে এই শব্দদূষণ রোধে কাজ করতে হবে। এবং এর মাধ্যমে মানুষ ও প্রাণীর নিরাপদ শ্রবণ নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, সকল স্তরের মানুষকে সংযুক্ত করে শব্দদূষণ রোধে কাজ করতে হবে। হাইড্রলিক হর্ন বাজানো নিষেধের আগে এর বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। শব্দদূষণ গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত ডাটাবেজ সংরক্ষণ করতে হবে এবং তা জনগণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, প্রাণ প্রকৃতির উপর শব্দদূষণের প্রভাব রয়েছে, যেসব এলাকায় শব্দদূষণ বেশি হয় ওই এলাকা থেকে প্রাণীরা অন্য এলাকায় স্থানান্তরিত হয়। ফলে উদ্ভিদের পরাগায়ন ও প্রজনন ব্যাহত হয়।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জাকারিয়া বলেন, শব্দদূষণ নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করা প্রয়োজন। এছাড়া সরাসরি শব্দদূষণ মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ করলে নির্দিষ্ট এলাকায় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে।

শ্রবণ ব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. নাসিমা খাতুন বলেন, মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর শব্দদূষণের বিশেষ প্রভাবটি হলো শ্রবণ শক্তি হ্রাস। স্কুলগামী শিশুদের উপর শব্দদূষণের প্রভাব বেশি, বর্তমানে অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে ক্লাস করার জন্য তারা ইয়ারফোন ব্যবহার করে পাশাপাশি অতিরিক্ত গান-বাজনা ইত্যাদি শোনার ফলে পড়াশোনায় অমনোযোগিতা দেখা দিচ্ছে এবং তাদের খাবারে অরুচি সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

ওয়েবিনারে আরও যুক্ত ছিলেন প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. রাশিদা বেগম, ইকিউএমএস কনসালটিং লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক কাজী ফরহাদ ইকবাল, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক আলমগীর কবির, ইউএসএইড ও এফসিডও-র বায়ু ও শব্দদূষণ প্রকল্পের প্রোগ্রাম এসোসিয়েট ইঞ্জিনিয়ার মো. নাছির আহম্মেদ পাটোয়ারী।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.