ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানা যাচ্ছে না

বাজার

কয়েক মাস ধরেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে অস্থিরতা চলছে। জরুরি পণ্যগুলোরই দাম বেড়েছে দফায় দফায়। এর মধ্যে হঠাত্ জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে বাজারে যেন আগুন লেগেছে।

সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বড় স্থান করে নিয়েছে অসহনীয় পণ্যের বাজার। এ নিয়ে সপ্তাহ জুড়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা থেকে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের বিষয়টি অনুভব করা যায়। নিত্যপণ্যের দামের বর্তমান লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সব স্তরের মানুষ ভোগান্তিতে পড়লেও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য তা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। গরিব আছে সংকটে, আর মধ্যবিত্তরা দিশেহারা।

আমন মৌসুম শেষে বাজারে নতুন চাল আসায় দাম কমার কথা, কিন্তু কমেনি। মিলপর্যায় থেকে শুরু করে পাইকারি আড়ত ও খুচরা বাজারে চালের মজুত পর্যাপ্ত। থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বস্তা। তবুও কয়েক মাস ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সব ধরনের চালের দাম।

সর্বশেষ এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম কেজিতে তিন-পাঁচ টাকা বেড়ে ৫০-৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। পাশাপাশি সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজে ১৫ টাকা বেড়েছে। এছাড়া ভোজ্য তেল, আটা-ময়দা, চিনি, মুরগি ও গরুর মাংস এবং ডিমের দাম আরেক দফা বেড়েছে।

এদিন সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার দরের মূল্য তালিকায়ও চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী দেখা গেছে। সেখানে বলা হয়েছে, সপ্তাহের ব্যবধানে মোটা চাল ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি এই একই চাল গত বছর একই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি সরু চাল গত বছর একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, দারিদ্র্যের এই হার করোনাপূর্ব ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪১ শতাংশ হয়েছে। ২০২০ সালের অক্টোবরের বিবিএসের এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানুষের আয় ২০ শতাংশ কমে গেছে। একদিকে আয় কমেছে ২০ শতাংশ, অপরদিকে ব্যয় বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। তার মানে হলো, ১০০ টাকার আয় কমে ৮০ টাকা হয়েছে আর ১০০ টাকার ব্যয় বেড়ে ১৩৬ টাকা হয়েছে। আয়-ব্যয়ের ব্যবধান হলো ৫৬ শতাংশ।

টিসিবির তথ্যমতে, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ভোজ্য তেল হিসাবে সয়াবিন তেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ১০৪ টাকা। সেই সয়াবিন তেল আজ কিনতে হচ্ছে ১৬০ থেকে ২০০ টাকায়। দাম বৃদ্ধির এ হার প্রায় ৬০ শতাংশের বেশি। পাম অয়েলের দাম বেড়েছে প্রতি মনে ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। আরেকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হলো মসুর ডাল। তিন বছর আগে এর দাম ছিল কেজিপ্রতি ৫৫ টাকা। সেই ডাল আজকের বাজারে কিনতে হচ্ছে কেজিপ্রতি ৯৭ টাকা ৫০ পয়সায়। এর দাম বেড়েছে ৭৭ শতাংশেরও বেশি। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে আটার দাম ছিল কেজিপ্রতি ২৮ টাকা ৫০ পয়সা। বর্তমানে বাজারে এর দাম ৩৪ টাকা ৫০ পয়সা। আটার দাম বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ।

শিক্ষা পণ্যের কথা যদি ধরি তাহলে দেখব, ২০ টাকার খাতা এখন ২৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে শিক্ষা বাবদ ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। রান্নার জ্বালানি গ্যাস (এলপিজি) ২০১৯ সালে ১২ কেজির প্রতি সিলিন্ডারে ব্যয় হতো ৮৫০ টাকায়। এ ফেব্রুয়ারি মাসে তার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ২৪০ টাকা। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির এই হার প্রায় ৪৬ শতাংশ। পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু সেই পানির দামও বেড়েছে। ২০১৯ সালে ঢাকায় প্রতি হাজার লিটার পানির দাম নির্ধারিত ছিল ১১ টাকা ৫৭ পয়সা। আর ২০২২ সালে তা হয়েছে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। দাম বৃদ্ধির এই হার ৩১ শতাংশেরও বেশি। গত নভেম্বর থেকে পরিবহনের বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে আমাদের। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে ভাড়া সমন্বয় করা হয়েছে অসমভাবে। একটি পরিবহনের মোট ব্যয়ের ৪০ শতাংশ হলো জ্বালানি তেল। তেলের দাম বৃদ্ধিই যদি ভাড়া বৃদ্ধির কারণ হয়ে থাকে, তাহলে মোট ব্যয় বাড়ার কথা মাত্র ৮-৯ শতাংশ। কিন্তু সরকার ও মালিকপক্ষের সমঝোতায় সড়ক পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ২৭ শতাংশ আর লঞ্চ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ।

দেশে প্রতি বছরই বাড়ছে গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়ার উৎপাদন। ২০২০-২১ অর্থবছরেও প্রায় চার লাখ পশু উৎপাদন বেড়েছে। এর মধ্যে এক লাখ ৫৪ হাজারই গরু। চাহিদার তুলনায় মাংস উদ্বৃত্ত ১০ লাখ মেট্রিক টন। তারপরও গরুর মাংসের দাম বাড়ছে। রাজধানীর বাজারগুলোতে বর্তমানে গরুর মাংস ৬৫০ টাকা কেজি পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। মানভেদে কোথাও কোথাও ৬২৫ টাকা কেজি। খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা কেজি দরে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ২০২০ সালে ১৮টি সবজি বাজার পর্যবেক্ষণ করে বলেছে, সবজির দাম বেড়েছে ১০ শাতংশের বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুতের দফায় দফায় দাম বৃদ্ধি। অপরিহার্য আটটি উপ-খাতে ব্যয় বৃদ্ধির হার গড়ে প্রায় ৩৬ শতাংশ। এর মানে হলো, যে ব্যক্তি তিন বছর আগে মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করে জীবন নির্বাহ করতেন, তার জীবনমান বজায় রাখতে এখন আয় করতে হবে প্রতি মাসে ৪০ হাজার ৮০০ টাকা। এ অতিরিক্ত ১০ হাজার ৮০০ টাকার সমাধান কে দেবে? সেই দুশ্চিন্তায় নিদ্রাহীন রাত কাটাচ্ছেন অনেকে। দুর্গতির এখানেই শেষ নয়; আগামী দিনে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে ১১৫ শতাংশ।

রমজান শুরুর আরো দেড় মাস বাকি। অথচ এখনই প্রতিটি পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে চাল, ডাল, তেল, মাছ, গোশত, সবজিসহ প্রতিটি পণ্যমূল্য।

সাধারণত দ্রব্যমূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টি নির্ভর করে বাজারে পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। কিন্তু বর্তমানে দেশে এ নিয়ম খাটছে না। পণ্যের পর্যাপ্ত আমদানি ও সরবরাহ থাকলেও তা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এর পেছনে কাজ করছে বাজার সিন্ডিকেট। কখনো কখনো তারা পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। রমজান সামনে রেখে গত কয়েক বছরের মতো এবারও বাজারে বিভিন্ন পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। লক্ষণীয়, রমজানের আগে পণ্যের দাম বাড়ানো হলে পরে তা আর কমানো হয় না। কাজেই বাজারের নিয়ন্ত্রণ যাতে দুষ্টচক্রের হাতে চলে না যায়, সেজন্য কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক বাজারের নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব দেশে পড়বে এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে এবং পণ্যমূল্য নাগালের মধ্যে রাখতে বাজার মনিটরিং বাড়াতে হবে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.