
রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে অবস্থিত কেন্দ্রীয় শিশু পার্ক দীর্ঘদিন ধরেই পুরনো জরাজীর্ণ বিভিন্ন রাইড দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রায় দুই দশকে শিশু পার্কটিতে লাগেনি কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া। তাই উন্নতমানের বিনোদন সেবার সুযোগ সৃষ্টি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবান্ধব রাইড সংযোজন করতে পার্কটির আধুনিকায়নে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
পার্কটিতে নতুন ১৫টি আকর্ষণীয় রাইড সংযুক্ত করে এবং পার্কটির আধুনিকায়নে কিছু কাজ যুক্ত করে ৫৫৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কেন্দ্রীয় শিশুপার্ক আধুনিকায়নের প্রকল্প হাতে নিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। প্রকল্পটির প্রস্তাবনা ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে জুন ২০২৪ মেয়াদে বাস্তবায়ন করবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। প্রকল্পটির আওতায় বেশ কিছু খাতে অস্বাভাবিক ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে, যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।
কেন্দ্রীয় শিশু পার্ক আধুনিকায়নে ৬টি টয়লেট নির্মাণে সাত কোটি ৩০ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। অর্থাৎ একটি টয়লেট নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ২১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। অথচ রাজধানীতে সিটি করপোরেশনের আওতায় যেসব পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলোর নির্মাণব্যয় হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার মধ্যে। তাই অস্বাভাবিক খরচে টয়লেট নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।
অন্যদিকে প্রকল্পটিতে একটি ডিপ টিউবওয়েল নির্মাণে দুই কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। যেখানে ঢাকা ওয়াসার একেকটি ডিপ টিউবওয়েল নির্মাণে সর্বোচ্চ ১ কোটি ২০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বাড়তি এত বেশি টাকা ব্যয় প্রস্তাবনার বিষয়ে জানতে চেয়েছে কমিশন।
প্রকল্পে অটোমেটিক ওয়েভ বেইজড টিকেটিং সিস্টেম বাবদ ১০ কোটি টাকা, ৪টি এলইডি স্ক্রিন বাবদ ৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তাবনায় আর্থিক আইআরআর ২১ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং অর্থনৈতিক আইআরআর ৪৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ বলা হয়েছে যা অত্যধিক বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য সচিব মামুন আল রশিদ বলেন, শিশুপার্কটির আধুনিকায়নে বেশ কয়েকটি খাতে অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে, যা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক লেগেছে। এত ব্যয় কোনোভাবেই হতে পারে না। সামনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির পিইসি সভায় এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হবে এবং ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা অধিশাখা) আবু মো. মহিউদ্দিন কাদেরীবলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। যে প্রকৌশলী এই প্রস্তাবনা তৈরি করেছে তিনি ভালো বলতে পারবেন।
শিশু পার্কটির আধুনিকায়ন প্রকল্পটির ডিপিপি প্রণয়ন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলী আনিস। মোবাইল ফোনে তার কাছে অস্বাভাবিক ব্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান।
তিনি বলেন, আমি না দেখে কিছু বলতে পারব না। আমি ঢাকার বাইরে আছি। এ বিষয়ে আমাদের তথ্য কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা হয়। তার তৈরি করা প্রকল্পে প্রস্তাবনার বিষয়ে তথ্য কর্মকর্তা কীভাবে বিস্তারিত বলবেন, তা জানতে চাইলে তিনি লাইনটি কেটে দেন। এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের সময়ের আলো বলেন, বর্তমানে আমার কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।
প্রকল্পে পণ্যের দাম বেশি ধরার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এ ধরনের বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর একটি লক্ষ্য থাকে যে, তারা বাজেট বেশি প্রস্তাব করলে কমিশন তা কমাবেই। এই ভেবে তারা অনেক সময় বেশি প্রস্তাব করে। তবে বেশি প্রস্তাব দেওয়ার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে বেশি বরাদ্দ নেওয়া। যদি বেশি বরাদ্দ নিতে পারে তা হলে দেখা যায়, এখান থেকে একটা ফায়দা হাসিলেরও সুযোগ থাকে তাদের। এটাও একটা উদ্দেশ্য।
প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিনোদন সেবা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিশু-কিশোরসহ নাগরিকদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা। শিশু-কিশোরসহ জনগণের উন্নতমানের বিনোদন সেবার সুযোগ সৃষ্টি করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবান্ধব রাইড সংযোজন করা।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম, বিভিন্ন ধরনের রাইড ক্রয় ও স্থাপন ১৫টি, অটোম্যাটিক ওয়েব/অ্যাপ বেজড ডিজিটাল টিকেট সিস্টেম স্থাপন, সেন্ট্রাল সাউন্ড সিস্টেমসহ (১০ ফুট বাই ১৫ ফুট) এলইডি স্ক্রিন স্থাপন, এ ছাড়া পূর্ত কাজের মধ্যে গ্যালারি এম্ফিথিয়েটার, সীমানা প্রাচীর, ড্রেন, ভবন নির্মাণ, ভিজিটরদের জন্য শেড নির্মাণ, ইনটেরিয়র কাজ, বৃক্ষ রোপণ ইত্যাদিসহ অন্যান্য সৌন্দর্যবর্ধনমূলক কাজ রয়েছে।
প্রকল্পের প্রস্তাবনায় সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবান্ধব রাইড সংযোজনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রকল্প প্রস্তাবনায় যেসব রাইডসের ছবি ও ডিজাইন দেওয়া হয়েছে তাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবান্ধব রাইডসের কিছু দেওয়া হয়নি।
প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্যতম কাজের মধ্যে একটি হলো নগরবাসীর বিনোদন সেবার ব্যবস্থা করা। সেবা হিসেবে শাহবাগ কেন্দ্রীয় শিশু পার্ক নগরবাসীসহ শিশু-কিশোরদের দীর্ঘদিন ধরে বিনোদন সেবা প্রদান করে আসছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কেন্দ্রীয় শিশু পার্কে বিনোদন সেবা প্রদানে ১১টি রাইড ছিল। দীর্ঘদিন ধরে রাইডগুলো মেরামতপূর্বক বিনোদন সেবা প্রদান করে আসছিল। ব্যবহার অযোগ্য ৮টি রাইড নিলামের মাধ্যমে বিক্রয় করা হয় এবং ৩টি রাইড মেরামতপূর্বক স্থাপন কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। শিশু পার্কে স্থাপিত রাইডগুলো দীর্ঘদিনের পুরনো ও সীমিত হওয়ায় তার দ্বারা কাক্সিক্ষত বিনোদন সেবা প্রদান করা সম্ভব নয় বিধায় নতুন যুগোপযোগী আধুনিক রাইড স্থাপন করা জরুরি।
প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কেন্দ্রীয় শিশু পার্কটি ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিধায় দৈনন্দিন প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন উৎসব যেমন, ঈদুল আজহা, ঈদুল ফিতর, পহেলা বৈশাখ ও দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে থাকে।
দীর্ঘদিনের পুরনো ও সীমিত রাইড দ্বারা নাগরিকদের চাহিদা অনুসারে বিনোদন সেবা প্রদান করা যাচ্ছে না। এই প্রেক্ষাপটে মহানগরবাসীর চাহিদা অনুযায়ী কাক্সিক্ষত বিনোদন সেবা প্রদানের জন্য আধুনিক যুগোপযোগী রাইড স্থাপনের লক্ষ্যে আলোচ্য প্রকল্পটির প্রস্তাব করা হয়েছে।
Leave a Reply