
সরকারবিরোধী বড় জোট কিংবা ঐক্য গঠনের প্রারম্ভিক আলোচনা প্রায় শেষ করেছে বিএনপি। গেল সপ্তাহে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট বাদে প্রায় সবার সঙ্গে ‘অনানুষ্ঠানিক’ বৈঠক করেছে বিএনপি। যেসব বৈঠকে বিএনপি মতামত নিয়েছে বেশি, দিয়েছে কম। আলাদা করে ঐক্যফ্রন্ট, বাম ও ইসলামী দলের সঙ্গে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা আলোচনা করেছেন।
আলোচনায় শরিকরা বলছেন, কেবল বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে বৃহত্তর ঐক্যে যাবেন না তারা। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে একমত হলেই হবে জোট। এরপর যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে ঐক্যের গোড়াপত্তন করতে চান তারা। করোনার বিধিনিষেধে নিজেদের মাঠের কর্মসূচি বন্ধ থাকায় বিএনপি একে একে সব দলের সঙ্গে আলোচনা সেরেছে। বেশিরভাগ বৈঠক হয়েছে ক্লোজডোর। বিএনপি নেতাদের বাসা ও অফিসে হয়েছে ওসব বৈঠক। শুক্রবার রাতে বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেনের গুলশানের বাসায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে একান্ত বৈঠক হয়। নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সারের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি সাংগঠনিক কাজে ময়মনসিংহে ছিলেন। মাহমুদুর রহমান মান্না সময়ের আলোকে বলেন, তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ হয়নি। চা খেলাম দুজন। খাওয়ার ফাঁকে টুকটাক আলোচনা হয়েছে। তবে সিরিয়াস কিছু না। কার্যকরী একটি জোট কীভাবে করা যায়- তা নিয়ে কথা হয়েছে। দীর্ঘ বলার মতো কিছু আলোচনা হয়নি।
বৃহত্তর জোটের কারিগররা বলছেন, সরকার পতন ও নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ সরকার কায়েমের দাবিতে একমত সবাই। ঐক্যে নির্বাচন কমিশন গুরুত্ব না পেলেও প্রাধান্য পাবে নির্বাচন কাঠামো। সে সঙ্গে বর্তমান সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হতে না দেওয়া। এই জোট গঠনের কাজ পুরোদমে এগোচ্ছে। কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে হচ্ছে এই বৃহত্তর জোট। তবে সবার আগে যুদ্ধাপরাধীর দল জামায়াত নিয়ে তাদের অবস্থান খোলাসা করতে হবে। কারণ তাদের সঙ্গে নিয়ে ঐক্য হতে পারে না। আর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনের ইস্যুটি বাইরে থাকবে।
সূত্র বলছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার দাবিতে একাই আন্দোলন করতে চায় বিএনপি। দলীয় কোনো ইস্যুতে ঐক্যকে জড়াতে চায় না। আগের অভিজ্ঞতা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। বৃহত্তর জোটে ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের থাকা নিয়ে দোটানা থাকলেও যুক্ত হচ্ছে মন্টু-সুব্রতদের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম। জোটের নাম এখনও ঠিক না হলেও একাধিক নাম উঠে এসেছে আলোচনায়।
ঐক্যের আলোচনার টেবিলে আছে সংবিধানের ৭০ ধারা। যেখানে বলা আছে, কোনো সংসদ সদস্য দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। যদি দেন তবে তার সদস্যপদ বাতিল হবে। এই ধারা নিয়ে ঘোর আপত্তি আছে বাম গণতান্ত্রিক জোটের। জোটের সমন্বয়ক সাইফুল হক সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের মতে এটি অগণতান্ত্রিক। এ বিষয়ে বিএনপি কি প্রস্তাবনা কিংবা মনোভাব থাকবে তা পরিষ্কার করতে হবে।
তিনি বলেন, শুধু তাই নয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিএনপির ভবিষ্যৎ অবস্থান জানানো উচিত। বাহিনীগুলোর দায়মুক্তির বিষয়েও আমরা পরিষ্কার বক্তব্য চাই। বিএনপি যেহেতু জোটের মেজর স্টেকহোল্ডার তাই তাদের অনেক বিষয়ে সুরাহা করতে হবে। তাদের আত্মসমালোচনা জনগণের সামনে করলে ইতিবাচক একটি ধারণা তৈরি হবে। জোটের প্রতি জনআস্থার একটি ব্যাপার আছে। কেননা যেনতেন ঐক্য গড়ার আগ্রহ নেই বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি কিংবা বাম গণতান্ত্রিক জোটের।
সাইফুল হক বলেন, আমরা যেমন সরকারের বিষয়ে সমালোচনা করি, তেমনই বিএনপির অতীত কর্মকাণ্ডের কিছু সমালোচনা করি। কারণ তারা ক্ষমতায় থাকতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ ক্ষমতার অপব্যবহার ও আইনের অপশাসন চালিয়েছে। এগুলোর বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা দরকার। সে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষী ধারা যেগুলো আছে, তা বাদ দেওয়া, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রসঙ্গগুলো গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিএনপিকেও বলেছি, এসব বিষয়ে পরিষ্কার বক্তব্য প্রয়োজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জোটের একজন উদোক্তা জানান, বিএনপি আপাতত সবার মতামত নিচ্ছে। ছাড় দিয়ে সমমনা দলগুলোকে ঐক্যে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে। বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে ছাড় দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছেন তারা। যে স্বার্থে সামনে থাকছে ‘গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার’। সবাই জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে আপত্তি জানালে বিএনপি বলছে জামায়াত জোটগতভাবে এক হচ্ছে না। যুক্তি হিসেবে তাদের ভাষ্য- জামায়াত ২০ দলীয় জোটে আছে। আর যে জোট নন ফাংশন অবস্থায় আছে দীর্ঘদিন। অর্থাৎ ২০ দলকে সামনে আনতে চায় না বিএনপি। তবে জোটের কোনো ব্যক্তি কিংবা পার্টি চাইলে নতুন ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, জোটের নেতৃত্বে ক্ষমতায় গিয়ে সরকার গঠন করলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন- এটা আগেই সমাধান করতে হবে। অনেকে এ বিষয়ে যৌথ সরকার গঠনের প্রস্তাব দিলেও বিএনপি এখনও কিছু খোলাসা করেনি। সব মিলিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের দিকেই মতামত আসছে। তবে আমরা কেবলই বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য জোট করব না- এটা অন্তত পরিষ্কার।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সহসভাপতি তানিয়া রববলেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আদলে এ জোট হচ্ছে না। তবে ফ্রন্টের ব্যক্তিরা অনেকেই থাকবেন। আমাদের সঙ্গে ফোনে কিছু আলোচনা হয়েছে। দুই মার্চের পর বসে আলোচনা করা হবে। বিএনপির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে জানিয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, সব কালাকানুন বাতিল এবং মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত অঙ্গীকার অনুযায়ী দেশের সব নাগরিকের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিষয় এখনও আলোচনার টেবিলে আছে। আলোচনা যত বাড়বে আরও বিভিন্ন বিষয যুক্ত হবে। তবে জামায়াত প্রশ্নে কৌশলী সাকি বলেন, কে কীভাবে ঐক্যে আসে সেটা পরের বিষয়। জামায়াত থাকতে আলোচনা শুরু করতে রাজি নন বলে জানান বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান।
তিনি বলেন, বৃহত্তর ঐক্যের প্রশ্নে বিএনপির আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব এখনও পাওয়া যায়নি। তবে অনানুষ্ঠানিক কিছু কথাবার্তা হচ্ছে। আমাদের দলের বিষয়ে আমরা জানিয়েছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, বিএনপি-আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক ঐক্য হতে পারে না। কেননা এই দুদলের শাসনকে আমরা দুঃশাসন মনে করি।
Leave a Reply