সরকারি মূল্যের সত্যতা মেলে না বাজারে

বাজার

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের মূল্য তালিকায় ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। খুচরা বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের ক্ষেত্রে এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্যটির মিল নেই। তিন প্রতিষ্ঠানের মূল্য তালিকার সঙ্গে বাজার দরেও বিস্তর ফারাক। একই পণ্য একেক বাজারে ভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। অথচ সংস্থাগুলো বাজারে নিত্যপণ্যের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম দেখাচ্ছে।

ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দৈনিক নিত্যপণ্যের যে মূল্য তালিকা করছে তা নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। এতে সরকারের নীতিনির্ধারকরা পণ্যের প্রকৃত মূল্য সম্পর্কে জানতে পারছেন না। অন্যদিকে বাজার অভিযানে গিয়ে তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলো বিপাকে পড়ছে।

বুধবার তিন সংস্থার মূল্য তালিকা, হাতিরপুল কাঁচা বাজার, কাওরান বাজার ও নয়াবাজার ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এদিন দুই বাজারের ভোক্তারা অভিযোগ করেন-তারা প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। সরকারিভাবে পণ্যের যে মূল্য তালিকা দেওয়া হচ্ছে তার কোনো ভিত্তি নেই।

এ প্রসঙ্গে জানার জন্য কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমানের সঙ্গে যুগান্তরের কথা হয়। তিনি বলেন, প্রতিদিনই বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সরকারি সংস্থাগুলোকে পণ্যের মূল্য তালিকা তৈরি করতে হবে। তবে রাজধানীর একেকটি বাজারে পণ্য ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রি হয়। এটাও তাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। সরকারিভাবে পণ্যের মূল্য প্রকাশ করা সংস্থাগুলোর তালিকায় যদি বিভ্রান্তি থাকে, তবে ভোক্তারা আস্থা হারাবেন। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর বদনাম হবে। পাশাপাশি ভোক্তা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন।

জানা গেছে, টিসিবি ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তর তাদের ওয়েবসাইটে প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের মূল্য তালিকা প্রকাশ করে। এগুলো তারা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে বাজার তদারকির সঙ্গে জড়িত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতেও পাঠায়। এছাড়া প্রতিটি বাজারের ব্যবসায়ী সমিতি ও সিটি করপোরেশন যৌথভাবে পণ্যের মূল্য তালিকা ঝুলিয়ে রাখে।

কিন্তু এর একটির সঙ্গেও প্রকৃত মূল্যের কোনো মিল নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে তার চেয়ে কম লিখে রাখা হয়েছে। মূল্য তালিকা প্রতিদিন হালনাগাদ করারও তেমন নজির পাওয়া যায়নি। টিসিবি এবং কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পণ্যের মূল্য তালিকার নিচে ঢাকার ১৫টি খুচরা বাজারের নাম দেওয়া আছে। তারা এসব বাজার ঘুরে পণ্যের মূল্য তালিকা করে থাকে।

বুধবার যুগান্তরের পক্ষ থেকে সংস্থা দুটির তালিকাভুক্ত তিনটি বাজারে অনুসন্ধান চালানো হয়। সকালে নয়াবাজার, বেলা ১১টার দিকে হাতিরপুল কাঁচা বাজার, এরপর কাওরান বাজারে সরেজমিন গিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে মূল্যের ব্যবধান সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।

এ প্রসঙ্গে সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া সাপ্লাই চেইন বিশেষজ্ঞ মো. মজিবুল হক বলেন-সরকারি সংস্থাগুলো সরকার প্রধানকে পণ্যের মূল্য সম্পর্কে পূর্ণ তথ্য দেয় না। তারা তাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুনাম বৃদ্ধি করতে চায়। এমনকি কোনো সংস্থার সঙ্গে অন্য কোনো সংস্থার কাজের সমন্বয় নেই। সমন্বয় থাকলে মূল্য তালিকা নিয়ে এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতো না।

বুধবার টিসিবির দৈনিক বাজার পণ্যমূল্য তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেখানে প্রতি কেজি খোলা আটার মূল্য দেওয়া হয়েছে ৩৩-৩৬ টাকা। এই একই পণ্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মূল্য তালিকায় দেওয়া হয়েছে ৩৪-৩৫ টাকা। আবার এ খোলা আটা রাজধানীর একাধিক বাজারে সিটি করপোরেশনের মূল্য তালিকায় দেওয়া আছে ৩৪-৩৫ টাকা।

কিন্তু এই একই আটা রাজধানীর হাতিরপুল কাঁচাবাজার, নয়াবাজার ও কাওরান বাজারে গিয়ে ৩৫-৩৮ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে দেখা গেছে। একইভাবে টিসিবির মূল্য তালিকায় পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম দেওয়া আছে ৭৩০-৭৮০ টাকা। একই পণ্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের দৈনিক বাজার দরের তালিকায় ১০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া আছে ৭৪০-৭৮০ টাকা।

আর সিটি করপোরেশনের মূল্য তালিকায় আরও ১০ টাকা বাড়িয়ে লিখা আছে ৭৫০-৭৮০ টাকা। কিন্তু খুচরা বাজার ও সুপারশপে এ সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৭৬৫-৮০০ টাকায়। প্রতিকেজি চিনি টিসিবির মূল্য তালিকায় দেওয়া আছে ৭৫-৭৮ টাকা। এ চিনি কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মূল্য তালিকায় দেওয়া আছে ৭৫-৭৬ টাকা।

সিটি করপোরেশনের মূল্য তালিকায় দেওয়া আছে ৭৮ টাকা। যা রাজধানীর খুচরা বাজারে ৭৫-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নয়াবাজারের মুদি দোকানি মো. তুহিন বুধবার যুগান্তরকে বলেন, সরকারি তালিকার সঙ্গে বাজারের দাম সব সময় দুই থেকে তিন অথবা চার টাকা বাড়তি থাকে। তারা বাজারের সঙ্গে মিল রেখে কেন তালিকা তৈরি করে না তা বলতে পারব না। যদি বাজারে বাস্তব মূল্যের সঙ্গে তালিকার মিল থাকত, তবে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই উপকৃত হতেন। তিনি বলেন, প্রতিকেজি চিনি ৭৫-৮০ ও পাঁচ লিটারের সয়াবিন কোম্পানি ভেদে ৭৬৫-৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে।

পাশাপাশি টিসিবির পণ্যমূল্য তালিকায় প্রতি কেজি সরু চালেরর মধ্যে মিনিকেটের দাম দেওয়া আছে ৬০-৬৮ টাকা। একই চাল কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মূল্য তালিকায় ৬০-৬৫ টাকা। রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোর সামনে টানানো সিটি করপোরেশনের মূল্য তালিকায় ৬৫-৬৮ টাকা। কিন্তু কিছুটা হেরফের দামে এ মানের চাল রাজধানীর খুচরা বাজারে ৬৫-৭০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা দেছে।

রাজধানীর কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান বুধবার বলেন, অনেক সময় ক্রেতা সরকারের তালিকার সঙ্গে পণ্যের দামের তুলনা দেন। আমাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করেন। কিন্তু দেখা যায়, সরকারি প্রতিষ্ঠান যে তালিকা তৈরি করে তা ভুল না বলা গেলেও দাম কমিয়ে তৈরি করা। যে কারণে বিক্রেতা হিসাবে আমাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। তিনি বলেন আজ (বুধবার) খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৬৫-৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, প্রতিদিন টিসিবির জনবল দিয়ে একাধিক বাজার থেকে সকাল ৮টা সাড়ে ৮টার মধ্যে পণ্যমূল্য সংগ্রহের মাধ্যমে সেগুলো ওয়েবপেজে দেওয়া হয়। যদি কারও মনে হয় টিসিবির মূল্য তালিকায় পণ্যের মূল্য ভুল আছে, সেক্ষেত্রে আমাদের লিখিতভাবে দিলে আমরা তাকে অনুরূপভাবে এর ব্যাখ্যা জানাব।

দরকার হলে আমাদের সঙ্গে বাজারে নিয়ে যাব। তিনি আরও বলেন, টিসিবি যে শুধু পণ্যের প্রতিদিনের মূল্য প্রকাশ করে সেটা নয়, কোন পণ্যের দাম বাড়ল বা কমল সেটাও প্রকাশ করে থাকে। এতে ভোক্তাদের উপকার হয়। তালিকায় দেখানো দামের চেয়ে বাজার মূল্য বেশি, এ পার্থক্য কেন এ সংক্রান্ত প্রশ্নের তিনি কোনো উত্তর দেননি।

টিসিবির মূল্য তালিকায় কেজিতে ব্রয়লার মুরগির দাম দেওয়া আছে ১৪০-১৫০ টাকা। এ মুরগি কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের দৈনিক বাজার দরের তালিকায় দেওয়া আছে ১৫০-১৫৫ টাকা। একই মুরগি সিটি করপোরেশনের বাজার মূল্য তালিকায় দেওয়া আছে ১৫৫ টাকা কেজি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি রাজধানীর খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে ১৫৫-১৬০ টাকা কেজিতে। প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম টিসিবিতে দেওয়া আছে ৫৮০-৬২০ টাকা, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মূল্য তালিকায় দেওয়া আছে ৫৮০-৬০০ টাকা। সিটি করপোরেশনের তালিকায় দেওয়া আছে প্রতি কেজি ৬০০ টাকা। কিন্তু বাজারে এক সপ্তাহ ধরে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬২০ থেকে ৬৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বুধবার সরেজমিন গিয়ে হাতিরপুল কাঁচা বাজারের মাংস বিক্রেতা মো. হালিম মিয়ার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, পশুরহাটে সব ধরনের পশুর দাম বেড়েছে। তাই বেশি দামে এনে বেশি দরেই বিক্রি করতে হয়। গত দেড় সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬০০-৬২০ টাকা বিক্রি হলেও বর্তমানে সর্বোচ্চ ৬৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু সরকারি মূল্য তালিকায় তা আপডেট করা হয়নি।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, তাদের লোকজন প্রতিদিন সকালে বাজারে গিয়ে পণ্যের মূল্য তালিকা সংগ্রহ করে। পরে এগুলো প্রকাশ করা হয়। কোন বাজারে কেমন মূল্য আছে সেটাও প্রকাশ করা হয়। এছাড়া পাইকারি ও খুচরা বাজারের পার্থক্যও দেওয়া থাকে। রাজধানীর সঙ্গে অন্যান্য জেলার তুলনা করে পণ্যের দামও দেওয়া হয়। তাই আমাদের পণ্যমূল্য তালিকার সঙ্গে বাজারের মূল্য ভুল হওয়ার কথা নয়। তবে কোনো অসাধু ব্যবসায়ী যদি পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানতে চাইলে বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, সপ্তাহের ৬ দিন সার্বিকভাবে বাজার অভিযানের মাধ্যমে তদারকি করা হয়। অনেক সময় পণ্যমূল্যের জন্য বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। তাই অনেক সময় কত দরে কেনা ও বিক্রি কত টাকায় তা দেখে আমরা বাজার তদারকি করি। অনিয়ম পেলে ভোক্তার স্বার্থে আইনের আওতায় আনা হয়। সুত্রঃ যুগান্তর

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.