
ব্রহ্মপুত্রের চরে এসকাভেটর, বালু পরিবহনের ট্রাক্টর আর শ্রমিকের সমাবেশ। তীর থেকে অদূরে জেগে ওঠা চর পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ চলছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে জনস্বার্থে বড় কোনও প্রকল্পের কাজ। প্রকল্প ঠিকই কিন্তু সেটা জনস্বার্থে নয়, নদের বালু লুটের মহা আয়োজন! আয়োজক- এলাকার সংঘবদ্ধ বালুখেকোর দল আর অবৈধ ট্রাক্টর মালিক সমিতি। ব্রহ্মপুত্র নদের নিস্তরঙ্গ প্রবাহ বাধাগ্রস্থ করে প্রায় দুইশ’ মিটার সড়ক তৈরি করে সেই সড়ক পথেই চলছে বালু চুরি। অথচ, মাত্র কয়েক মিটারের মধ্যে বসতি, স্থাপনা আর ফসলি জমি। কুড়িগ্রামের রৌমারীর যাদুরচর ইউনিয়নের কর্তিমারী খেয়া ঘাটের চিত্র এটি।
চরাঞ্চলের মানুষ আর ফসল পারাপারের অজুহাত দেখালেও মূলত নদ থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রির উদ্দেশ্যে এই সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন স্থানীয়রা।
প্রসঙ্গত, কুড়িগ্রামে কোনও বালুমহাল নেই। তবে বছর জুড়েই এ জেলার প্রায় প্রতিটি নদ-নদী হতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও বিক্রির মহোৎসব চলে। অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট নদী ভাঙনে শত শত পরিবার বাস্তুহারা হলেও অবৈধ এ কাজ বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। ক্ষেত্র বিশেষে দায়সারা কিছু অভিযান পরিচালিত হলেও নদ-নদী অববাহিকায় বালু লুটের চিত্র অপরিবর্তিতই থাকে। যেন দেখার কেউ নেই।
কর্তিমারী খেয়া ঘাটের ইজারাদার ও যাদুরচর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন অভিযোগ করেন, ‘যাদুরচর ইউনিয়ন ট্রাক্টর (কাঁকড়া গাড়ি) মালিক সমিতির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম জাহিদ, সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমানসহ ২৫/৩০ জন ট্রাক্টরের মালিক নিজেদের অর্থ ব্যয় করে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সড়ক নির্মাণ করেছেন। তাদের আসল উদ্দেশ্য নদের বালু উত্তোলন করে ওই পথে পরিবহন করা।’
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘গত বছরও একই কায়দায় ব্রহ্মপুত্রের ওই স্থানে সড়ক নির্মাণ করে অবৈধ ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলন ও বিক্রি করে চক্রটি। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় নদের ভাঙনে গতবছর দুটি গ্রাম বিলীন হয়েছে। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে জানালেও কোনও প্রতিকার মেলেনি।’
কর্তিমারী নৌঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, নদের পানি প্রবাহ বন্ধ করে বালু পরিবহন করার জন্য সড়ক নির্মাণ হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, নদ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় প্রতি বছর নদের তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দেয়। ভাঙনে ফসলি জমি ও বাস্তুহারা হলেও প্রভাবশালী এসব বালু ব্যবসায়ী ও ট্রাক্টর মালিকদের ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলার সাহস পান না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাঙনের শিকার স্থানীয় কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, প্রতি বছর ড্রেজার মেশিন আর ট্রাক্টরে করে নদ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় বন্যার সময় এলাকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দেয়। এতে গত বছর বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন নদতীরবর্তী দেড় শতাধিক পরিবার। এছাড়াও নদের ভাঙনে বেড়িবাঁধের (চাক্তাবাড়ি-ধনারচর-রাজিবপুর বেড়িবাঁধ) একাংশ, মসজিদসহ কয়েকশত হেক্টর ফসলি জমি বিলীন হয়েছে। কিন্তু বেপরোয়া বালু ব্যবসায়ীদের কোনোভাবে থামানো যাচ্ছে না। নদ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধের দাবি জানান স্থানীয়রা।
ব্রহ্মপুত্রের বুকে রাস্তা নির্মাণের কথা স্বীকার করে রৌমারী উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়ন ট্রাক্টর মালিক সমিতির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দিগলাপাড়ার টোটাল জমাজমি চরে। আমরা যেমন বালু আনবো (উত্তোলন) তদ্রুপ আমাদের ফসলাদিও আনা দরকার। এ জন্য রাস্তা করা হয়েছে। এটা নিজেদের অর্থেই নির্মাণ করা হচ্ছে। কারণ আমরা এখানে ব্যবসা করবো।’
দেশের প্রচলিত আইনে এটা নিষিদ্ধ জানেন কি না, এমন প্রশ্নে জাহিদ বলেন, ‘হ্যাঁ, জানি। কিন্তু তারপরও আমরা গতবছরও সড়ক নির্মাণ করে বালু আনছি, এবারও আনছি। আমরা মূল নদী থেকে বালু আনছি না, এটা নদের কোল বা শাখা।’
তবে স্থানীয়রা বলছেন, এভাবে বালু উত্তোলনের ফলে প্রতিবছর ভাঙনে এসব কোল বা শাখার সৃষ্টি হচ্ছে যা বর্ষা মৌসুমে মূল নদের ধারায় একীভূত হয়ে পড়ে।
রৌমারীর অনেক স্থানেই নদ-নদী থেকে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে জানিয়ে রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, রৌমারী উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক শাহ আব্দুল মোমেন বলেন, ‘কোনও বালুমহাল না থাকলেও এ উপজেলা অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের স্বর্গরাজ্য। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এরা বেপরোয়া। প্রশাসন সব কিছু জানার পরও বেশিরভাগ সময় নিরব থাকে। নদী ভাঙনে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকেও এরা আমলে নেয় না।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) উত্তরাঞ্চলের সমন্বয়কারী তন্ময় সান্যাল বলেন, ‘বালুমহাল ছাড়া বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ। বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ অনুযায়ী বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনও আবাসিক এলাকার এক কিলোমিটারের মধ্যে উন্মুক্ত স্থান বা নদীর তলদেশ হতে বালু বা মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ। একই আইনে বালু বা মাটি উত্তোলন ও বিপণনের উদ্দেশ্যে ড্রেজিংয়ের ফলে কোনও নদীর তীর ভাঙনের শিকার হতে পারে , এরূপ ক্ষেত্রে বালু বা মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ। এসব অপরাধে অনূর্ধ্ব দুই বছরের কারাদণ্ড ও সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল ইমরান বলেন, ‘বিষয়টি জানার পরপরই সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের তহশিলদারকে পাঠিয়ে নদের বুকে সড়ক নির্মাণ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছি।’ এরপরও এমন কাজ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। সুত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন
Leave a Reply