
শৈশব প্রতিটি শিশুর জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। একটি চমৎকার ও আনন্দময় শৈশব শিশুর অধিকার যা এক প্রকার মানবাধিকারও বটে। শিশুর সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আনন্দময় শৈশব অত্যন্ত জরুরি। আর এ দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি বর্তায় মা-বাবার ওপর।
একটি শিশুর আনন্দময় শৈশবের সঙ্গে উন্মুক্ত স্থান কিংবা খেলার মাঠ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। আজকাল অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উন্মুক্ত স্থান কিংবা মাঠ না থাকার কারণে শিশুরা খেলাধুলা করার সুযোগ পায় না। শিশুদের শারীরিক বিকাশ ও মানসিক প্রশান্তির জন্য খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। খেলাধুলার সুযোগ না পেলে শিশু-কিশোরদের মাথায় নানা ধরনের খারাপ চিন্তা ভর করে। এর ফলে শিশু-শিশুদের বিপথে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। বর্তমানে আনন্দময় শৈশব নেই বলে শিশু নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটছে।
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের শিশুর শৈশব নানা কারণে বিপন্ন। সেভ দ্য চিলড্রেনের ২০১৭ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় উঠে এসেছেÑ প্রায় ৭০০ মিলিয়ন শিশু তাদের শৈশবকে হারিয়ে ফেলেছে। সিরিয়া, আফগানিস্তান, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শিশুরা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিপন্ন শৈশবের কারণে কিশোর-কিশোরীরা অল্প বয়সে নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে।
প্রযুক্তির ভিড়ে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে শিশুদের চিরচেনা সেই শৈশবের স্মৃতি। প্রযুক্তি কেড়ে নিচ্ছে শিশুর সৃজনশীলতা, শিশুকে করছে চার দেয়ালে গৃহবন্দি। বর্তমানে অনেক শিশু-কিশোর ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনে আসক্ত। কেউ গেমে কেউ ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, কেউ আবার পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। এই আসক্তির বিষয়টি সারা পৃথিবীতেই উদ্বেগজনক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনলাইন গেম, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার বা ভিডিও গেমের ক্ষতিকর ব্যবহারকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইউনিসেফের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে ৩২ শতাংশই অনলাইন বিপদের মুখে আছে। এ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশে^ প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু।
আর প্রতিদিন ১ লাখ ৭৫ হাজার অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু নতুন করে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে শিশুরা খুব সহজেই ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশ করে। ৩-৪ বছরের বাচ্চারাও এখন ইউটিউবে নানা ধরনের ভিডিও দেখে। শিশুরা এখন স্মার্টফোনে কার্টুন দেখার নেশায় মেতে ওঠে। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে শিশুদের প্রায় ৩.৫ শতাংশ নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে শিশুদের জন্য উন্মুক্ত স্থান ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। একসময় যে খরস্রোতা খাল-বিলে শিশুরা সাঁতার কাটত ধীরে ধীরে এখন সেগুলোও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েক বছর আগেও আমাদের দেশের শিশুরা গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, ডাংগুলি, লাটিম, মার্বেল, ফুটবল, ক্রিকেট, হা-ডু-ডু খেলায় মেতে থাকত। শিশু-কিশোরদের কোলাহলে মাঠ-ঘাট মুখরিত হয়ে উঠত। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় সোনালি অতীতের সেসব খেলাধুলা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। সুবিধাবঞ্চিত, অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল শিশুরা দিন দিন শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
শিশুর ভালো কাজ যতই ছোট হোক তাকে ধন্যবাদ দিতে হবে। তার ভালো কাজের প্রশংসা করতে হবে। মন্দ কাজে নিরুৎসাহিত করতে হবে। শিশুর অনুসন্ধিৎসু মনের কৌতূহল মেটাতে হবে। সে যা জানতে চায় তার উত্তর দিতে হবে, বিরক্ত হওয়া যাবে না। শিশুর শৈশব অনাবিল আনন্দ আর হাসিতে ভরিয়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। এ জন্য পিতামাতা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের বেশি করে সময় দিতে হবে। মাঝেমধ্যে তাকে দূরে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। এতে করে শিশুরা নতুন করে উৎসাহ, উদ্দীপনা পাবে। শিশুকে সামাজিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে কীভাবে অন্যদের সঙ্গে মিশতে হয় তা শেখাতে হবে। শিশুদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। শিশুকে কোনোভাবেই অতিরিক্ত আদর কিংবা শাসন করা যাবে না।
জীবনের সবচেয়ে মধুর সময় শৈশব। শিশুর শৈশবকে আনন্দময় করে গড়ে তুলতে হলে বেদখল মাঠগুলোকে পুনরুদ্ধার করে শিশুদের জন্য উন্মুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুর আনন্দময় শৈশব নিশ্চিত করতে হলে সুশৃঙ্খল পারিবারিক পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ একজন শিশু তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় অতিবাহিত করে থাকে। তা ছাড়া প্রচলিত শিশু আইনকে যুগোপযোগী ও শিশুবান্ধব করতে হবে
শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম
Leave a Reply