

মনোনয়ন বাণিজ্যের প্রায় সব অভিযোগই আওয়ামী লীগের জেলার নেতা ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে। রোববার চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচনের পর দেখা গেছে, যেসব এলাকায় মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ ছিল সেসব এলাকায় নৌকার ভরাডুবিও হয়েছে বেশি। তবে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ মানতে নারাজ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় হাই কমান্ড ও মনোনয়ন বোর্ড। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক সময়ের আলোকে বলেন, এসব মিথ্যা অভিযোগ। তবে তৃণমূলে কিছু হয়ে থাকতে পারে। বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দলের সভাপতিমণ্ডলী ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের আরেক সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সময়ের আলোকে বলেন, নির্বাচনে হেরে যাওয়া পক্ষ ১০০টা কারণ দাঁড় করায়। অন্যের ওপর দোষ চাপায়। কেউ বলেন বাণিজ্য হয়েছে। কেউ বলেন পুলিশকে ঘুষ দিয়েছে। ভোট কিনে জয়ী হয়েছে। তিনি বলেন, এটা শুধু বাংলাদেশে না, ট্রাম্পও (ডোনাল্ড ট্রাম্প) নির্বাচনে হারার পর বলেছিলেন, নির্বাচন ঠিক হয়নি। তারপরও আমরা বিষয়গুলো দেখছি। অভিযোগগুলো যদি সত্যি হয়, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফেরও একই মন্তব্য। তিনি বলেন, এগুলো ভিত্তিহীন অভিযোগ। তথ্যপ্রমাণ ছাড়া আমি এসব অভিযোগকে যুক্তিযুক্ত মনে করি না। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে, যাচাই করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব।
কেন্দ্রীয় নেতারা মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগকে উড়িয়ে দিলেও দলটির তৃণমূলের নেতারা এসব অভিযোগ করছেন প্রকাশ্যেই। শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলায় মোটা অঙ্কে নৌকার মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার সিংঙ্গাবরুণা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা রহুল আমিন বলেন, টাকার বিনিময়ে রাজাকার পুত্র, বিএনপি নেতা, ফ্রিডম পার্টির লোকজন এখন নৌকার মালিক। আদর্শ নয়, টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন দিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
ভোটের ফলে দেখা যায়, এ উপজেলায় নৌকার প্রার্থীদের পরাজয়ের হার বেশি। শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সাতটিতেই হেরেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। শ্রীবরদীতে নৌকার এমন ভরাডুবির বিষয়ে শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হুইপ আতিউর রহমান আতিক সময়ের আলোকে বলেন, মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ আমার জানা নেই। যতটুকু দেখলাম, দল ও এমপির (একেএম ফজলুল হক) মধ্যে দূরত্বের কারণে নৌকা প্রতীকের পরাজয় হয়েছে। তিনি বলেন, নৌকার পরাজয়ের মূল কারণ বিদ্রোহী প্রার্থী। আমার সদর আসনেও ১৪টি ইউপির মধ্যে আমরা ৫টিতে জয়ী হতে পারিনি। বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থার বিষয়ে তিনি বলেন, দলের সভানেত্রীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যারা প্রার্থী হয়েছে কেন্দ্রের সঙ্গে আলাপ করে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকুর বিরুদ্ধে শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ করেন মনোনয়ন বঞ্চিত সদর উপজেলার হাজিরপাড়া ইউপির স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান মো. সামছুল আলম বাবুল। তিনি বলেন, দলীয় মনোনয়নের জন্য জেলা সভাপতি পিংকু আমার কাছে ৬০ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন। তা দিতে না পারায় তার চাচাতো ভাই ও রাজাকার পুত্র মাসরুকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। গত ইউপি নির্বাচনে আমার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা নিয়েছিলেন পিংকু।
রোববার চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে এ ইউপিতে নৌকা প্রতীক হেরেছে। জয় পেয়েছেন বাবুল। শুধু বাবুলই নন, লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টিতেই নৌকার প্রার্থীরা জিততে পারেননি। সাতটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী, ছয়টিতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এবং দুটিতে বিএনপিদলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। মনোনয়ন বাণিজ্যের ক্ষোভ থেকেই ১৫টি ইউনিয়নের প্রায় সবগুলোতে একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র হিসেবে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন। সম্প্রতি তৃণমূলের বর্ধিত সভায়ও কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে মনোনয়ন বাণিজ্য নিয়ে অভিযোগ করেন মনোনয়ন বঞ্চিতরা।
এই জেলা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এর আগেও মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে বিভিন্ন ইউনিয়নের নেতারা বক্তব্য রাখেন। শুধু সদর নয়; বিভিন্ন উপজেলা থেকেও মনোনয়ন বাণিজ্যের অনেক অভিযোগ উঠেছে।
মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ ইউপি নির্বাচনের আগের ধাপগুলোতেও ছিল। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের পর এক ফেসবুক পোস্ট দিয়ে দলীয় মনোনয়নে অর্থ লেনদেনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানান সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। তিনি লেখেন, ‘২০৬ ইউপিতে আওয়ামী লীগের মতো শক্তিশালী দল নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে হারবে কেন? অর্থ পরিষ্কার, সেই বিদ্রোহী প্রার্থীর টাকার জোর ছিল না; কিন্তু তিনি ছিলেন এলাকায় জনপ্রিয়, তিনি কোনো নেতা-এমপির পকেটে যাননি। তিনি জনগণকে ভালোবেসে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করেছেন। তাই দল নিয়ে যারা ব্যবসা করেন তারা জানুন এবার আওয়ামী লীগ হেরেছে আওয়ামী লীগের কাছে। মনোনয়ন দেওয়ার সময় অনেক স্থানে বাণিজ্যের কাছে হার মেনেছে জনপ্রিয়তা। অন্যদিকে দিনশেষে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় মানুষটিই জয়ী হয়েছেন, আওয়ামী লীগ তো হারেনি। মনোনয়ন বাণিজ্য পরাজিত হয়েছে।’
মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার ইউনিয়নগুলোতেও মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে কালকিনির সাহেবরামপুর ইউপিতে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মুরাদ সরদার। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাইয়ে দিতে এক কেন্দ্রীয় নেতা, যিনি সংসদ সদস্যও, আমার কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা নিয়েছেন। মনোনয়ন না পাওয়ায় টাকা ফেরত চাইলে তিনি আমাকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তাহমিনা সিদ্দিকিও বলেন, মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণেই নৌকার ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত কালকিনিতে নৌকার পরাজয় হয়েছে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের কাছে যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও তৃণমূলে বিতর্কিত চিহ্নিত হয়েছেন অনেকে। এ নিয়ে দলের ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা বিক্ষোভও করেছেন।
কেন্দ্রীয় নেতারা বাণিজ্যের বিষয়গুলো অস্বীকার করলেও সম্প্রতি ফাঁস হওয়া কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রোশন আলী মাস্টার এবং জেলার দেবীদ্বার উপজেলা বিএনপি নেতা রুহুল আমীনের ফোনালাপেও মনোনয়ন বাণিজ্যের বিষয়গুলো উঠে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ওই অডিওতে আওয়ামী লীগ নেতা রোশন আলী মাস্টারকে বলতে শোনা যায়, ‘কী হবে এ দেশে রাজনীতি করে? টাকা দিলেই নমিনেশন পাওয়া যায়, মন্ত্রিত্ব পাওয়া যায়।’
রোববার চতুর্থ ধাপে ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ৩৯৬ জন জয়ী হয়েছেন। অন্যদিকে ৩৯০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) জয়ী হয়েছেন। এ ধাপে ৮৩৬টি ইউপিতে ভোটগ্রহণ হয়। তবে সরাসরি ভোটে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীর জয় বিদ্রোহীদের চেয়ে কম। সরাসরি ভোট হয় ৭৯৭টি ইউপিতে। সে হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন ৩৫০টিতে। পক্ষান্তরে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৩৮৯টিতে। এর আগে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নৌকা প্রতীকের ৪৬ জন জয়ী হন। তৃতীয় ধাপের নির্বাচনেও সরাসরি ভোটে আওয়ামী লীগের চেয়ে স্বতন্ত্ররা বেশি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
Leave a Reply