
ঢাকাঃ বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ১৯৬৪-এ রয়েছে, ভাড়াটিয়া ব্যক্তি বাসা বা দোকান ভাড়া নেওয়ার দুই বছর পার না হলে মালিক ভাড়া বাড়াতে পারবেন না। ভাড়া পরিশোধ নিয়ে কোনো বিরোধ দেখা দিলে বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়ার দরখাস্তের ভিত্তিতে দুই বছর পর পর ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক’ যাচাই-বাছাই করে মানসম্মত ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করতে পারবেন। বাড়িওয়ালা যদি মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে আদায় করেন তাহলে প্রথমবার অপরাধের জন্য মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং পরে প্রতিবার অপরাধের জন্য ওই অতিরিক্ত টাকার তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কিন্তু বাড়ি মালিকদের প্রভাবের কারণে ভাড়াটিয়ারা আইনি প্রতিকার পান না।
বাড়িভাড়া আইনে দুই বছর অন্তর অন্তর বাড়ানোর কথা বললেও বাস্তবে তা ভিন্ন। বছর ঘুরতে না ঘুরতে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির নোটিস পাচ্ছেন ভাড়াটিয়ারা। আর আইন অনুযায়ী ভাড়া বৃদ্ধি দুই পক্ষের সমঝোতার কথা থাকলেও তা হয় না। বাড়ির মালিক তার ইচ্ছামতো ভাড়া বৃদ্ধি করে তা চাপিয়ে দেন ভাড়াটিয়াদের ওপর। মালিকদের এমন ইচ্ছার প্রভাবে না থাকতে পেরে বাসা ছাড়তে হয়েছে অনেককেই। বাড়িভাড়া বৃদ্ধির নৈরাজ্য চলছে। তাদের এই নৈরাজ্য রোধে তদারকি করতে দেখা যায় না কোনো সংস্থাকে। ঢাকা শহরে বাড়াটিয়ার সংখ্যা কত তার তথ্য কোথাও নেই। তবে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৫টি ওয়ার্ডে ২ লাখ ৫১ হাজার ৩০২টি হোল্ডিং (আবাসিক এবং বাণিজ্যক) রয়েছে। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪টি ওয়ার্ডে হোল্ডিং রয়েছে ৩ লাখ ৩৮ হাজার। সে হিসাবে দুই সিটিতে হোল্ডিং আছে ৫ লাখ ৮৯ হাজার।
আর ক্যাবের তথ্য অনযায়ী, ২০১০ সালে দুই কক্ষের পাকা বাসার গড় ভাড়া ছিল ১১ হাজার ৩০০ টাকা। বছর বছর বেড়ে ২০১৯ সালে তা ২৪ হাজার ৫৯০ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ এই সময়ে পাকা বাসার গড় ভাড়া বেড়েছে ১৩ হাজার ২৯০ টাকা। আধা পাকা (টিন শেড) বাড়ির দুই কক্ষের ভাড়া ২০১০ সালে ছিল ৬ হাজার ৮০০ টাকা, যা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১৯ সালে ১৩ হাজার ২০০ টাকা হয়েছে।
একইভাবে বেড়েছে মেস ও বস্তির বাড়িভাড়া। ২০১০ সালে দুই কক্ষের মেসের গড় ভাড়া ছিল ১১ হাজার ৫০০ টাকা, যা বেড়ে ২০১৯ সালে হয় ২৩ হাজার ২০০ টাকা। এ হিসাবে গড়ে মেস ভাড়া বেড়েছে ১১ হাজার ৭০০ টাকা। আর ২০১০ সালে বস্তির দুই কক্ষের ভাড়া ছিল ৩ হাজার ৯০০ টাকা, যা বছর বছর বেড়ে ২০১৯ সালে হয় ১০ হাজার ৭০০ টাকা। অর্থাৎ বস্তির দুই কক্ষের গড় ভাড়া বেড়েছে ছয় হাজার ৮০০ টাকা।
এ থেকে দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক বছরে ঢাকার সব শ্রেণির বাড়িভাড়া বেড়েছে। তবে অন্যদের তুলনায় নিম্ন আয়ের মানুষ বা যারা টিনশেড বাড়িতে ভাড়া থাকেন তাদের ওপর চাপ বেশি পড়েছে। কারণ গত কয়েক বছরে ঢাকার টিনশেড বাড়ির ভাড়া বেড়েছে সবথেকে বেশি।
বনশ্রীতে একটি বাড়িতে ৩ বছর ধরে আছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মো. মিজানুর রহমান। তার বাড়ি মালিক গত বছর বাড়িভাড়া না বাড়ালেও এ বছর ডিসেম্বরের শুরুতে বৃদ্ধির নোটিস দিয়ে গেছে। তাও ৫০০ বা ১০০০ টাকা নয়, ২ হাজার টাকা বাড়াবে এমন নোটিশ। আগে ছিল ১২ হাজার এখন ১৪ হাজারে পৌঁছাবে। তার ওপর আছে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ও সার্ভিস চার্জ। কিন্তু সেবার মান ও আয় বাড়েনি তার। উল্টো ১২ বছরে তার খরচ বেড়েছে শতকরা ১৮ ভাগ। এই সাংবাদিকের এখন সংসারের ঘানি টানতে হিমশিম অবস্থা। কিন্তু বাড়ির মালিকের কথা এভাবে না থাকতে পারলে চলে যান।
রামপুরার একটি টিনশেড বাড়িতে ভাড়া থাকেন মো. আলী হোসেন। তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে দুই রুম ভাড়া নিয়ে এই বাড়িতে উঠি। প্রথমে দুই রুমের ভাড়া ছিল ৬ হাজার টাকা। এখন সাড়ে ৮ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এভাবে বাড়িভাড়া বাড়লেও আয় বাড়েনি। বরং করোনার কারণে এখন আয় কমে গেছে।’
এ বিষয়ে রাজধানীতে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, বছর না ঘুরতে মালিকরা তাদের ইচ্ছামতো ভাড়া বৃদ্ধি করে নোটিস দেন। আইনকে কোন তোয়াক্কা করছেন না তারা। ইচ্ছামতো ভাড়া বৃদ্ধি করে তা চাপিয়ে দেন ভাড়াটিয়াদের ওপর। এমনও বলে দেয়, না পোষালে চলে যান। এমন অযৌক্তিক ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানায়। একইসঙ্গে এই বছর বাড়ির মালিকদের প্রতি অনুরোধ থাকল যেন বাড়িভাড়া বৃদ্ধি না করেন।
তিনি আরো বলেন, আমি সিটি করপোরেশন মেয়রদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। তারা যেন এ বিষয়ে প্রদক্ষেপ নেন। আর বাড়িভাড়া আইন বাস্তবায়নে যেন তারা ভূমিকা রাখেন।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সম্প্রতি এক গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে বলেন, বাড়িভাড়া নিয়ে হাইকোর্টের একটা নির্দেশনা আছে। তবে এখনকার যে আইনটা আছে এটা ভাড়াটে বান্ধব না। তিনি বলেন, বাড়িভাড়া যেন বাস্তবসম্মত হয় সে রকম একটা পদক্ষেপ নেওয়া এখন যুক্তিযুক্ত।
গোলাম রহমান আরো বলেন, বর্তমানে ভাড়াটিয়াদের প্রতিকার পাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। তিনি দাবি রেখে বলেন, ভাড়াটিয়া যাতে প্রতিকার পায় এমন একটা আইন করতে হবে যাতে করে বাড়িভাড়া বেশি নিলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
আমাদের বাণী/বাংলাদেশ/০৭/১২/২০২১
Leave a Reply