
ঢাকাঃ চলতি বছরের নভেম্বর মাসে সারা দেশে ৩৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৪১৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫৩২ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৬৭ জন, ৫৮ জন শিশু এবং শিক্ষার্থী ৫৪ জন। এ ছাড়া এই সময়ে শুধু ঢাকায় ১৪টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৬ জন।
শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। সাতটি জাতীয় দৈনিক, পাঁচটি অনলাইন নিউজপোর্টাল এবং ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি।
শনিবারও রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় মাহদী হাসান লিমন নামে গ্রিন ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী লরির ধাক্কায় নিহত হয়েছেন। একই দিনে বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের জাকির হোসেন সড়কের ঝাউতলা এলাকার রেল ক্রসিংয়ে বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও টেম্পোর সঙ্গে ডেমু ট্রেনের সংঘর্ষ ঘটে। এতে পুলিশ সদস্যসহ তিনজনের মৃত্যু হয়। তাদের একজন পাহাড়তলি ডিগ্রি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের এইচএসসি পরীক্ষার্থী শাহীন। একটি পরীক্ষাও দিয়েছিলেন তিনি।
চলতি বছরের নভেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও নটরডেম কলেজের ২ জনসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫৪ জন শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। এরপর ২৯ নভেম্বর রাতে অনাবিল পরিবহনের চাপায় নিহত হয় রামপুরা একরামুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাঈনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। মোট মৃত্যুর ৪৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ ঘটেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। নভেম্বর মাসে ১৫৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৮৪ জন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪১ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
দুর্ঘটনায় ৯৬ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। এই সময়ে ৭টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৯ জন নিহত এবং ৫ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ১১টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত এবং ২ জন আহত হয়েছেন। নভেম্বরে সংঘটিত দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৫৬টি জাতীয় মহাসড়কে, ১৩১টি আঞ্চলিক সড়কে, ৫৩টি গ্রামীণ সড়কে, ৩৫টি শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৪টি। দুর্ঘটনাগুলোর ৮৯টি মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৩৩টি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ৯১টি পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেওয়া, ৫৯টি যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ৭টি অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান-পিকআপ ২১ দশমিক ৪২ শতাংশ, ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ড্রাম ট্রাক ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স-জিপ ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ, মোটরসাইকেল ৩০ দশমিক ৫৮ শতাংশ, থ্রিহুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-মিশুক-লেগুনা-টেম্পু) ১৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-পাখিভ্যান-বোরাক-মাহিন্দ্র-টমটম) ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল ১ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে ভোরে ৫ শতাংশ, সকালে ২৭ দশমিক ১৭ শতাংশ, দুপুরে ১৭ দশমিক ৪১ শতাংশ, বিকালে ২২ দশমিক ১৬ শতাংশ, সন্ধ্যায় ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং রাতে ২১ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ, প্রাণহানি ঘটেছে ২৬ দশমিক ৫১ শতাংশ; রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ, প্রাণহানি ১৩ দশমিক ৪২ শতাংশ; চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৯ দশমিক ৩২ শতাংশ, প্রাণহানি ২১ দশমিক ৮১ শতাংশ; খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ, প্রাণহানি ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ; বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৮ দশমিক ২১ শতাংশ, প্রাণহানি ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ; সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ, প্রাণহানি ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ; রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ, প্রাণহানি ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৭ দশমিক ১৬ শতাংশ, প্রাণহানি ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি, গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজিকে পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
সড়কে দুর্ঘটনা রোধে কিছু সুপারিশ করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য পার্শ্বরাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করা, পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করা, গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, রেল ও নৌপথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা, পথের ওপর চাপ কমানো, টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করা উল্লেখযোগ্য।
এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার ঊর্ধ্বমুখী হলেও এটা নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে। এই অবস্থার উন্নয়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে।
আমাদের বাণী/বাংলাদেশ/০৫/১২/২০২১
Leave a Reply