গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলার মূলে ছাত্ররা নয় বাসমালিকরা

ঢাকাঃ রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাসমালিকদের অসহযোগিতায় তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিশেষ করে চুক্তিভিত্তিক বাস চালানো, নিয়মবহির্ভূত ওয়েবিল পদ্ধতি, শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া নেওয়া, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধসহ নানা দাবি ওঠে। সরকারের পক্ষ থেকে এসব নৈরাজ্য বন্ধ করাতে বারবার কড়া নির্দেশ দিলেও বাসমালিকরা তার কোনো পরোয়া করছে না। সম্প্রতি গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে গঠিত বাস রুট রেশনালাইজেশন কার্যক্রমেও নানা রফাদফা তুলে অসহযোগিতা করছেন তারা। ফলে তিন দফায় তারিখ পরিবর্তন করে আগামী ২৬ ডিসেম্বর বিআরটিসি বাস নিয়ে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ চালু করার ঘোষণা দেয় বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি। এর আগে চলতি বছরের ১ এপ্রিল, ৭ সেপ্টেম্বর ও ১ ডিসেম্বর থেকে এ সার্ভির চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
গত রবিবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনে এ সংক্রান্ত একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে কমিটির আহ্বায়ক ও ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস জানান, বাসমালিকদের অসহযোগিতার কারণে ১ ডিসেম্বর থেকে নগর পরিবহনের যাত্রা শুরু করা যাচ্ছে না। আবেদনকারী বাসগুলোর ফিটনেস ও অন্যান্য সমস্যার কারণে আপাতত ৩০টি বিআরটিসি বাসসহ ১০০টি বাস দিয়ে এ সার্ভিস চালু করতে কাজ করে যাচ্ছে কমিটি। আগামী ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে যেসব বাস ফিটনেস সনদসহ অন্যান্য শর্ত পূরণ করতে পারবে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাস রুট রেশনালাইজেশনের উদ্যোগ নেওয়ার ৫ বছর পেরিয়ে গেছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আনিসুল হক ২০১৬ সালে এ উদ্যোগ নেন। ২০১৭ সালে তার মৃত্যুতে থেমে যায় সে উদ্যোগ। এরপর ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগরীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ও যানজট নিরসনের জন্য ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন ও কোম্পানির মাধ্যমে বাস পরিচালনা’ পদ্ধতি প্রবর্তনের কার্যক্রম সমন্বয় করতে একটি কমিটি গঠন করে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
দশ সদস্যের ওই কমিটির আহ্বায়ক করা হয় ডিএসসিসির তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকনকে। বর্তমানে কমিটির আহ্বায়ক ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। পরে ২০১৯ সালে অন্য একটি প্রজ্ঞাপনে ডিএনসিসির একজন প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করে ১২ সদস্যের কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। কমিটি সৃষ্টির ৩ বছরে ১৯টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এরপরও ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু করতে পারেনি। আর গোটা রাজধানীর গণপরিবহনের শৃঙ্খলা এখনও অধরা।
সূত্রগুলো বলছে, দীর্ঘদিন ধরে গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলে আসছে। এর পেছনে নানা রকম আর্থিক বিষয় ও অনিয়ম জড়িত। এগুলো ছেড়ে শৃঙ্খলায় আসতে চাচ্ছেন না বাসমালিকরা। বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির ১৯তম বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, মতিঝিল-ঘাটারচর রুটে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ চালুর উদ্যোগ নেওয়ার পর চার শতাধিক বাসমালিক এতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আবেদন করেন। যাচাই-বাছাইয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে ১২০টি বাসের ফিটনেস সনদসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাগজপত্র ঠিক করতে বলে কমিটি। কিন্তু কমিটির পূর্বঘোষিত উদ্বোধনের মাত্র তিনদিন আগে রোববার এ নিয়ে বৈঠকে বসে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি। কমিটির সদস্যরা জানান, ঢাকা নগর পরিবহনে যুক্ত হতে আবেদন করা ১২০ বাসের মধ্যে ১১৪টি বাসের ফিটনেস সনদসহ অন্য সব কাগজপত্র জমা দিতে পারেনি।
এ বিষয়ে বাসমালিকদের ভাষ্য, তারা কাগজপত্র ঠিক করতে আবেদন করেছেন। আপাতত এভাবেই বাসগুলোকে ঢাকা নগর পরিবহনে যুক্ত করার দাবি জানান তারা। কিন্তু কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য এ পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে। সেখানেও যদি বিশৃঙ্খলা থাকে, তবে এই কমিটি সফল হতে পারবে না। তাই বিআরটিসির ৩০টি বাস নিয়ে আগামী ২৬ ডিসেম্বর থেকে এ পরিবহনের যাত্রা শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মোট ১০০টি বাস নিয়ে এ রুটে যাত্রা শুরু করতে চায় বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি। এজন্য আগামী ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব বেসরকারি বাস ফিটনেসসহ আনুষঙ্গিক শর্ত পূরণ করতে পারবে তাদের নেওয়া হবে। আর এ রুটে চলাচলকারী অন্যসব বাস বন্ধ করে দেওয়া হবে। তাদের অন্য রুটে চলাচল করার অনুমতি দেওয়া হবে। এ নিয়েও বাস মালিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ রুটে চলাচলকারী অন্য বাস কোম্পানি সহজেই এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছে না। তাই ফিটনেস সনদসহ অন্যান্য শর্ত শিথিল করে তাদের অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছেন। এ নিয়ে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সদস্যদের কাছে বিভিন্ন মহল থেকে তদবিরও করা হচ্ছে।
এদিকে মতিঝিল-ঘাটারচর রুটে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ চলাচল করার সব ধরেনর ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে কাউন্টার নির্মাণ, দূরত্ব ও ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। এ রুটের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে কিলোমিটার প্রতি ২ টাকা ২০ পয়সা। এ নিয়েও মালিকদের আপত্তি রয়েছে। এ ছাড়া দাঁড় করিয়ে যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দেওয়ার দাবিও করেছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাস রুট রেশনালাইজেশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী বর্তমানে ঢাকার ২৯১টি রুটের পরিবর্তে ২২ রুটে চলবে ৬ কোম্পানির ১০ হাজার বাস। প্রতিটি কোম্পানির বাসে পৃথক ছয়টি রঙ থাকবে। গোলাপি, নীল, হালকা সবুজ, কমলা, হলুদ ও সবুজ রঙ দ্বারা বিভিন্ন কোম্পানির বাস চিহ্নিত করা হবে। সঠিকভাবে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিটি কোম্পানিতে ৫০০টির কম গণপরিবহন রাখা হবে। কোম্পানিগুলোকে আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের জন্য কর্তৃপক্ষ গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। কোনো রুটে ৫ বছরের বেশি পুরনো বাস রাখা হবে না।
প্রস্তাবে রুটগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে- আরবান, সাব-আরবান ও ঢাকা চাকা ক্লাস্টার। বাস রুট রেশনালাইজেশনের জন্য জেলা পর্যায়ের কোনো বাস রাজধানীতে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এজন্য রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোতে ১০টি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এসব টার্মিনালের স্থানও নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- কেরানীগঞ্জের বাঘৈর, হেমায়েতপুর, উত্তরার বিরুলিয়া, গাজীপুর, নবীনগর চন্দ্রা রোডের বাইপাইল, কাঞ্চন, কাঁচপুর উত্তর, কাঁচপুর দক্ষিণ মদন, আঁটিবাজারের ভাওয়াল ও ভুলতা। ঢাকার বাইরের গাড়িগুলো এসব টার্মিনালে এসে থামবে। আর সেখান থেকে যাত্রীরা নগর পরিবহনের মাধ্যমে নির্ধারিত স্থানে যাতায়াত করতে পারবে। এতে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরার পাশাপাশি ঢাকার যানজটও নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির এক সদস্য সময়ের আলোকে বলেন, বাসমালিকদের নানা শর্তের কারণে কাজে বিলম্ব হচ্ছে। ঘাটারচর-মতিঝিল রুটের বাসগুলো শর্ত পূরণ করতে পারেনি। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও দিতে পারেনি। কাগজপত্রের ঘাটতি রেখেই কাজ শুরু করে দেওয়ার আবদার তাদের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ঘাটারচর-মতিঝিল রুটসহ সব রুটেই বেসরকারি বাস থাকবে। এত বড় আর বিপুলসংখ্যক মানুষ শুধু বিআরটিসি বাস দিয়ে যেতে পারবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেসব বাস সব শর্ত পূরণ করতে পারেনি, তারাও কাগজপত্র ঠিক করছে। সুত্রঃ সময়ের আলো

আমাদের বাণী/বাংলাদেশ/৩০/১১/২০২১

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.