
ঢাকাঃ স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ১৭টি নথি গায়েব ঘটনায় কয়েক রাঘব-বোয়ালের নাম উঠে এসেছে। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে আরও তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরা হচ্ছে অহিদ খান, সেলিম ও হাবিব। তাদের মধ্যে অহিদ খান স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। বাকি দুইজন মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। এদিকে এ নিয়ে এই মামলায় মন্ত্রণালয়ের ৯ জন কর্মচারী ও ১ জন ঠিকাদারকে সিআইডি হেফাজতে নিয়েছে। সোমবার এ ঘটনায় নাসিমুল গণি টোটন নামে এক ঠিকাদারকে রাজশাহী নগরীর রাজপাড়া থানার কেশবপুর এলাকার বাড়ি থেকে ঢাকা সিআইডির একটি দল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেয়। পরে রাতেই তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ফাইল চুরির ঘটনা নতুন নয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে এই মন্ত্রণালয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল চুরি করে রাঘব বোয়ালদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এর বিনিময়ে তারা মোটা অঙ্কের অর্থ পান। এর আগেও একই কায়দায় ফাইল চুরি হলে সে ঘটনাও ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। তবে এবার নড়ে চড়ে বসেছেন স্বাস্থ্য সচিব আলী নূর। তিনি কঠোর মনোভাব নিয়ে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের কঠোর শাস্তির মনোভাব নিয়ে বিষয়গুলো দেখভাল করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাদিরা হায়দার বাদী হয়ে মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ থেকে ১৭টি নথি খোয়া যাওয়ার ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। শাহবাগ থানার ওসি মওদুত হাওলাদার জানান, ফাইল হারিয়ে যাওয়া নিয়ে গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি জিডি করেছে। শুক্র ও শনিবার সরকারী ছুটি থাকায় সচিবালয় বন্ধ ছিল। রবিবার থেকে তদন্ত শুরু করে সিআইডি। জিডিতে বলা হয়েছে, গত ২৭ অক্টোবর বুধবার অফিস করে নথিগুলো ফাইল কেবিনেটে রাখা হয়। পরদিন দুপুর ১২টায় কাজ করতে গিয়ে দেখা যায় ফাইলগুলো কেবিনেটের মধ্যে নেই। যে নথিগুলো খোয়া গেছে সেগুলোর সিংহভাগই স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের অধীন বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও বিভাগের কেনাকাটা সম্পর্কিত। জিডিতে ১৭টি নথির নম্বর ও বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজসহ অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজের কেনাকাটা সংক্রান্ত একাধিক নথি, ইলেকট্রনিক ডেটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচী, রিপোর্ট অধিদফতরের কেনাকাটা, ট্রেনিং স্কুলের যানবাহন বরাদ্দ ও ক্রয় সংক্রান্ত নথি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরও জানায়, ঘটনার পর সিআইডির ক্রাইম সিনের সদস্যরা সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করে। মন্ত্রণালয়ের নিচতলায় অতিরিক্ত সচিব মোঃ শাহাদাৎ হোসাইন ও যুগ্ম সচিব কাজী আনোয়ার হোসেনের কক্ষে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেন। এ সময় তারা সবার আঙ্গুলের ছাপ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেক করেন। অন্তত ১৩ জনের আঙ্গুলের ছাপ নেন। সিআইডির বিশেষ সুপার মোঃ কামরুজ্জামান জানান, মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১৭টি নথি গায়েবের ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটা জিডি করা হয়েছে। এরপর সিআইডি তদন্ত শুরু করে। ঘটনার প্রথম দিনে মন্ত্রণালয়ে ৬ কর্মচারী জিজ্ঞাসাবাদে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। তা যাচাই করা হয়েছে। এ নিয়ে ১০ জনকে হেফাজতে নেয়া হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সূত্র জানায়, মঙ্গলবারও সিআইডির একটি টিম মন্ত্রণালয়ের তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সিআইডি দফতরে নিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের ৯ জনসহ ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেয়া হয়েছে।
এদিকে সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, রবিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জোসেফ, আয়শা, বাদল, বারী, মিন্টু ও ফয়সাল নামে ৬ জন কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সিআইডি দফতরে নিয়ে আসা হয়। এরপরই সোমবার রাতে রাজশাহী থেকে নাসিমুল গণি টোটন নামে এক ঠিকাদারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকায় আনা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানায়, এই ফাইল চুরির সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত থাকতে পারে। তাদের হাত অনেক দূর পর্যন্ত। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে এদের আরও ব্যাপক জেরা করার প্রয়োজনে গ্রেফতার করা হতে পারে। স্বাস্থ্য সচিব আলী নূর জানান, ফাইল গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনায় ‘কেউই সন্দেহের উর্ধে নন। এ ঘটনায় অতিরিক্ত সচিব মোঃ শাহ্ আলমকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছে, চিকিৎসা শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব মোঃ আহসান কবীর, উপ-সচিব আবদুল কাদের ও বিভাগের উপসচিব মল্লিকা খাতুন। কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আশা করছি এই সপ্তাহের মধ্যেই রিপোর্ট পাব।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানায়, দেড় মাস আগেও একই শাখা থেকে ফাইল গায়েব হয়েছিল। সেই ঘটনার এখনও সুরাহা হয়নি। বরং ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই ফাইলটি ছিল রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ সংক্রান্ত। ফাইল গায়েব হওয়ার পর তিন দিনের ভেতরে ফাইল খুঁজে দেয়ার জন্য আয়েশা সিদ্দিকাকে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু তিনি চিঠির জবাব দেননি। পরে তাকে শো’কজ করা হয়। আয়েশা সিদ্দিকা বর্তমানে অন্তঃসত্ত¡া। সে সময় চিঠির জবাবে তিনি বেশিরভাগই তার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানান। তখন তিনি জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। এরপর নিয়ম অনুযায়ী, সে জবাব সন্তোষজনক না হওয়াতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রশাসনিক শাখায় অভিযোগ পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরে তার শরীরের অবস্থা বিবেচনা ও সন্তানের ওপর কোন প্রভাব পড়ে কিনা চিন্তা করে এ্যাকশনের বিষয়টি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
একই ঘটনায় অতিরিক্ত সচিব মোঃ শাহাদাত হোসাইন গণমাধ্যমকে জানান, ফাইল গায়েব হওয়ার ঘটনায় জিডি করা হয়েছে শাহবাগ থানায়। সিআইডি, এনএসআই এসেছে। এখন তো আমাদের আইনী প্রক্রিয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। তারা আমাদের সবার মোবাইল নম্বর নিয়েছে। আগামীকাল থেকে এর হদিস বের করার চেষ্টা করা হবে। রবিবারে সব স্টাফ আসার পর পুলিশসহ সবাই তদন্ত করবে। নথি গায়েবের ঘটনাকে ভয়াবহ উল্লেখ করে শাহাদাত হোসেন বলেছেন-এটা অনেক ভয়াবহ বিষয়, কারণ নথি তো একটা ডকুমেন্ট। এটা সরকারী ডকুমেন্ট। এই সরকারী ডকুমেন্ট নাই। এটা তো বারবার ঘটতে পারে। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, পুনরাবৃত্তি না হয় এবং এর একটা সলিউশন যেন হয়, সে জন্য যেভাবে যা করার আমরা করছি।
ফাইল চুরির ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত-
স্বাস্থ্যমন্ত্রী॥ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, মন্ত্রণালয় থেকে ফাইল চুরির ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত এবং এ ঘটনায় আমরা ক্ষুব্ধ। এ বিষয়ে যা যা পদক্ষেপ নেয়া দরকার আমরা নিয়েছি। তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। এসময় তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে ফাইল চুরির ঘটনায় আইনী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এবং পুলিশ এ ঘটনার তদন্ত করছে। তদন্ত পরবর্তীতেও আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
প্রসঙ্গত, গত ৩০ অক্টোবর জানা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগের ১৭টি ফাইল গায়েব হয়েছে। তাতে শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে মন্ত্রণালয়।
আমাদের বাণী/বাংলাদেশ/০২/১১/২০২১
Leave a Reply