ইউপি নির্বাচনে দাপট বিদ্রোহীদের

ইউপি নির্বাচন

ঢাকাঃ স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উতপ্ত হয়ে উঠেছে তৃণমূল। ভোটের বিরোধী শিবিরের শক্ত প্রতিপক্ষ না থাকলেও অধিকাংশ ইউপিতে সরকারি দলের নৌকা প্রতীকের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ নিজ দলের বিদ্রোহীরা। দায়িত্বশীল নেতাদের কঠোর অবস্থান ও হুঙ্কার পাত্তা দিচ্ছেন না বিদ্রোহীরা।

যার কারণে তৃণমূলে মুখোমুখি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থানে নিজেদের মধ্যে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছেন। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিভেদ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন আ.লীগের দায়িত্বশীল নেতারা। তৃণমূলের চেইন অব কমান্ড বজায় রাখতে কঠোর অবস্থানে নিয়েছেন দলটির নেতারা।

কোনভাবেই বিদ্রোহীকে ছাড় দিতে নারাজ। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে। শুধু বহিষ্কার বা অব্যাহতি নয়, ভবিষ্যতে দলের কোনো পদ-পদবিতে (বিদ্রোহী) না রাখায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থান নিয়েছে হাইকমান্ড। বিদ্রোহীদের মদতদাতাদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আগামী ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৬৯১ জন বিদ্রোহী প্রার্থী ভোটের মাঠে রয়েছে। অনেক স্থানে বিদ্রোহীদের দাপটে নৌকার প্রার্থীরা প্রচারণাও চালাতে পারছেন না। দলীয়ভাবে ইউপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও বিএনপির ৩১১ জন স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনের মাঠে আছেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থী আছেন ১০১ জন। তৃতীয় ধাপের নির্বাচনেও আ.লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা সক্রিয় রয়েছেন।

দ্বিতীয় ধাপের ইউপির মনোনয়নে দায়িত্বশীল নেতাদের যোগসাজশে অনিয়ম-দুর্নীতি করা হয়েছে এমন সহস্র্রাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে কেন্দ্রে। অধিকাংশ অভিযোগই স্থানীয় এমপির বিরুদ্ধে। যদিও স্থানীয় এমপিদের মনোনয়ন বোর্ডে রাখা হয়নি। কিন্তু তারপরও এমপিরা যাদের চেয়েছেন তারাই দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন অধিকাংশ।

যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে স্বাক্ষর জালসহ অর্থ বাণিজ্যের ভিত্তিতে সুবিধাবাদী নব্য আ.লীগারদের মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে। দলের দুঃসময়ে যারা রাজপথে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের বাদ দিয়ে এলাকায় থাকেন না এমন ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে বলে প্রায় অভিযোগে বলা হয়েছে।

এমন অভিযোগ তুলে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন অনেকে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই বিদ্রোহীরা ‘সাধারণ ক্ষমা’ পাবেন এমন ধারণা থেকেও দলের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বলে মনে করছেন আ.লীগের নীতিনির্ধারকরা। সে কারণে বিদ্রোহীদের দমানো যাচ্ছে না।

দ্বিতীয় ধাপে শরীয়তপুর সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে তিনটি চেয়ারম্যান পদে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নৌকার প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। বাকি সাতটি ইউনিয়নে রয়েছে বিদ্রোহী প্রার্থী। গত ৩০ অক্টোবর বিদ্রোহী হয়েছে এমন ১০ জনকে বহিষ্কার করেছে স্থানীয় আ.লীগ।

বহিষ্কৃতরা হলেন— সদর উপজেলার রুদ্রকর ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি, সদর উপজেলা আ.লীগের সদস্য ও বর্তমান চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান ঢালী, তুলাসার ইউনিয়নে উপজেলা আ.লীগের সদস্য জাহিদুল ইসলাম জাহিদ, মাহমুদপুর ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি ও সদর উপজেলা আ.লীগের সদস্য বর্তমান চেয়ারম্যান শাহজাহান ঢালী, আ.লীগের সাধারণ সদস্য শাহিন তালুকদার, তার স্ত্রী সদর উপজেলা মহিলা আ.লীগের সভাপতি ইরানি বেগম, ডোমসার আ.লীগের সাধারণ সদস্য মাস্টার মজিবুর রহমান, শৌলপাড়া ইউনিয়নে সদর উপজেলা আ.লীগের সদস্য আব্দুল মান্নান খান ভাষানী, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি এসকেন্দার সরদার, পালং ইউনিয়নে আ.লীগের সাধারণ সদস্য আজাহার খান ও আংগারিয়া ইউনিয়ন জেলা আ.লীগের সদস্য আনোয়ার হোসেন হাওলাদার।

এ বিষয়ে শরীয়তপুর জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দে বলেন, দলীয় মনোনয়ন ফর্ম জমা দেয়ার সময়ে তারা অঙ্গীকার করেছিল, মনোনয়ন না পেলে আ.লীগের প্রার্থীদের পক্ষে থাকবেন এবং বিদ্রোহী হলে অটোমেটিক বহিষ্কার হবেন। সেই আলোকেই সদর উপজেলার যারা বিদ্রোহী হয়েছেন তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। আগামী ধাপেও যারা বিদ্রোহী হবেন— তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শুধু শরীয়তপুর নয়, সারা দেশেই বিদ্রোহীদের বহিষ্কার করা শুরু হয়েছে। নওগাঁ সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হিসেবে অংশ নেয়ায় আ.লীগের সভাপতি আবদুল গফুরকে বহিষ্কার করা হয়। নওগাঁয় জেলার ২০টি ইউপিতে আ.লীগের ৪২ জন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। এরমধ্যে নওগাঁ সদর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে ২৭ জন, রানীনগর আটটি ইউনিয়নে ১৫ জন। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের চান্দাইকোনার প্রার্থী হয়েছেন আজমল হোসেন। প্রতীক বরাদ্দের দিন রাতে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

পরে অবশ্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত বদলে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দেন তিনি। জামালপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আ.লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হওয়ায় সাইফুল ইসলাম খানকে যুবলীগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

সাইফুল ইসলাম খান জামালপুর সদর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় দ্বিতীয় ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় বাইশারী ও দৌছড়ির ইউনিয়ন আ.লীগ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

বহিষ্কৃত নেতারা হলেন— বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়ন আ.লীগ সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম বাহাদুর, দৌছড়ি ইউনিয়ন আ.লীগ সভাপতি আলহাজ মুহাম্মদ হাবীব উল্লাহ। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আ.লীগের মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে উপজেলা আ.লীগের চার নেতা ও ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ মোট ৯ জনকে বহিষ্কার করেছে উপজেলা আ.লীগ।

গত ২৮ অক্টোবর বেলা ১১টায় উপজেলা আ.লীগের বিশেষ বর্ধিতসভায় নেতাদের বহিষ্কারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন মিরপুর উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিন।

বহিষ্কৃত আ.লীগ নেতারা হলেন— উপজেলা আ.লীগের সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম সেন্টু, শিল্প ও বাণিজ্যক সম্পাদক আলমগীর হোসেন, সহ-দপ্তর সম্পাদক নুরুল ইসলাম, তালবাড়ী ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি আব্দুল হান্নান মণ্ডল, আমবাড়ীয়া ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি আব্দুল বারী টুটুল, কুর্শা ইউনিয়ন আ.লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহন লাল, উপজেলা আ.লীগের সদস্য আসাদুজ্জামান সুমন, উপজেলা কৃষক লীগের সহ-সভাপতি কবির হোসেন বিশ্বাস ও সদস্য ইব্রাহিম খলিল। টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার চারটি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হওয়ায় পাঁচজনকে আ.লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

বহিষ্কৃতরা হলেন— উপজেলার কাঁকড়াজান ইউপিতে উপজেলা আ.লীগের প্রাথমিক সদস্য মো. দুলাল হোসেন, বহেড়াতৈল ইউপিতে বর্তমান চেয়ারম্যান উপজেলা আ.লীগের সদস্য গোলাম ফেরদৌস, যাদবপুর ইউপিতে সাবেক চেয়ারম্যান উপজেলা আ.লীগের সাবেক কোষাধ্যক্ষ খন্দকার বজলুর রহমান, বহুরিয়া ইউপিতে আ.লীগের সাবেক সভাপতি ও ইউনিয়ন আ.লীগের ১ নম্বর সদস্য নুরে আলম এবং একই ইউপির প্রার্থী আ.লীগের প্রাথমিক সদস্য নিরাঞ্জন বিশ্বাস। নড়াইলের লোহাগড়া আ.লীগ নেতা ও বর্তমান পৌরমেয়র আশরাফুল আলমকে লোহাগড়া আ.লীগ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। আশরাফুল আলম উপজেলা আ.লীগের সহসভাপতি ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

আ.লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘দল করলে সবাইকে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। ইউপি নির্বাচনে দল থেকে প্রার্থী দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে যারাই বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই বিদ্রোহীদের পেছনে যারা মদত দিচ্ছেন, নির্বাচনে কাজ করছেন যে বড় নেতাই হোন না কেন, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

আমাদের বাণী/বাংলাদেশ/০১/১১/২০২১ 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.