জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির চিন্তা সরকারের!

ঢাকাঃ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আসছে শীতে এই দাম আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুৎ, তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর কথা ভাবছে সরকার। ইতোমধ্যে তেলের দাম বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।

পাওয়ার সেল বলছে, সরকার বিদ্যুৎ খাতে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। যে হারে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়ছে তাতে বছরে ভর্তুকির পরিমাণ ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের কথা ভাবা হচ্ছে। এ ছাড়া এলপিজির দাম বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে দেশে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকারি পর্যায়েও গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়েও আলোচনা চলছে।

অন্যদিকে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ঝুঁকছে সরকার। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারেও তেলের দাম আকাশচুম্বী। বেশি দামে এলএনজি কেনায় আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি লাগছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দাম বাড়ানোর বিষয়টি সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সময়ের আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতসহ পার্শ্ববর্তী সব দেশ দাম বাড়িয়েছে দিয়েছে। বিষয়টি (মূল্যবৃদ্ধি) নিয়ে কাজ চলছে। এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে সম্ভাবনা রয়েছে।

বিপিসির পরিচালক (অপারেশন) সৈয়দ মেহেদী হাসান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বিপিসির প্রতিদিন গড়ে লোকসান হয় ২১ কোটি টাকা। প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ৬৯ ডলার হলে কোনো লস হয় না বিপিসির। দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতি লিটার ফার্নেস ওয়েলে লোকসান হচ্ছে ৭ টাকা, প্রতি লিটার ডিজেলে লোকসান হচ্ছে ১৩ থেকে ১৪ টাকা। লোকসান কমাতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, বিইআরসির মতো বিপিসিও যেন আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে-কমাতে পারে, চিঠিতে সেই ক্ষমতা পুরোপুরি বিপিসিকে দেওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, দেশে বছরে প্রায় ৫৫ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। এখন ১ ব্যারেল ডিজেল কিনতে হয় ৫৪ ডলারে, এ বছরে ডিজেল আমদানির চাহিদা ধরা হয়েছে ৪০ লাখ মে টন। আর ১ ব্যারেল অকটেন কিনতে হচ্ছে ১০৪.০৭ ডলারে, অকটেন আমদানির চাহিদা ধরা হয়েছে ২ লাখ ব্যারেল। ৪৮৬.০৬ ডলারে কিনতে হচ্ছে প্রতি মেট্রিক টন ফার্নেস ওয়েল, এ বছরে ফর্নেস ওয়েল আমদানির চাহিদা ধরা হয়েছে সাড়ে ৫ লাখ মেট্রিক টন। এ ছাড়া প্রতি মেট্রিক টন মেরিন ওয়েল কিনতে হচ্ছে ৬১৩.১৯ ডলারে, বছরে মেরিন ওয়েল আমদানির চাহিদা ধরা হয়েছে দেড় লাখ মেট্রিক টন, ইতোমধ্যে ১৫ হাজার মেট্রিক টন আমদানি করা হয়েছে।

প্রতিদিন গড়ে ডিজেল বিক্রি হয় ১২ হাজার ৮০০ টন। ফার্নেস অয়েল বিক্রি হয় ২ হাজার টন। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো নিয়ে একটি সভা হয়েছে। সেখানে জ্বালানি বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, তারা গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, আগামীতে আমাদের নতুন সমস্যা হচ্ছে প্রাথমিক জ্বালানি। বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম ৫ গুণ বেড়ে গেছে, তেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে, কয়লার দামও বেড়েছে ৫ গুণ। অতিরিক্ত খরচ মিটানোর জন্য আগামীতে আমাদের বিদ্যুতের ট্যারিফ পরিবর্তন করতে হবে। এখন বিদ্যুৎ খাতে যে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয় তা ১৮ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে। এলএনজি যেখানে ছিল ৮ থেকে ৯ ডলার এখন ৪০ ডলার। বড় পুকুরিয়ার কয়লা নিয়েও সমস্যা হচ্ছে। বিপিসি যদি তেলের দাম বাড়ায় তাহলে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, তেল, গ্যাস ও কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আর আন্তর্জাতিক বাজারে এই তিনটার দামই আকাশচুম্বী। বিপিসি তেলের দাম বাড়ালে তো বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোরও প্রস্তাব করা হবে। এটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে। এখনও প্রস্তাব করা হয়নি। কিন্তু প্রস্তাব করাটাই তো স্বাভাবিক।

তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতে কত ভর্তুকি দেওয়া হবে এটা সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক পলিসিও জড়িত। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, বাড়বে কিনা এটা এখনও বলা যাচ্ছে না, দেখা যাক।

আন্তর্জাতিক বাজারে মঙ্গলবার প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৮৪.২৭ ডলার, যা সোমবারের তুলনায় প্রায় .৫০ ডলার বেশি । গত ১২ অক্টোবর দাম উঠেছিল ৯৪ ডলার। আর গত বছরের নভেম্বরে দাম ছিল ৩৬.৪৬ ডলার। এ বছরের ২০ আগস্ট দাম ছিল মাত্র ৬৫.১৮ ডলার। এই দাম ১০০ ডলারে যাওয়ার আশঙ্কাও আছে। এর আগে ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর তেলের দাম ৮০ ডলারের ওপরে উঠেছিল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ আরও সঙ্কটে পড়বে। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, কয়েক মাসে আগে যে এলএনজির দাম ৬ ডলারের মধ্যে ছিল তা এখন ‘স্পট মার্কেট’ থেকে প্রতি এমএমবিটিইউ (ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) এলএনজি ৩২ থেকে ৩৬ ডলারে কিনতে হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে এখন এলএনজির যে তিনটি কার্গো আমদানি করা হয় তাতে আগের চেয়ে ২ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা বেশি লাগবে।

আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দামও বেড়েছে। অক্টোবরে গ্যাসোলিনের দাম গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত বছরের এপ্রিলে প্রতি গ্যালনের দাম ছিল ১ দশমিক ৭৭ ডলার। আন্তর্জাতিক জ্বালানি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনার প্রভাব কমতে থাকায় এবং চাহিদা বাড়তে থাকায় খুব দ্রুতই এই দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক লুইস ডিকসন বলেছেন, বিশেষ করে এশিয়ার জন্য, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তেল একটি কার্যকর বিকল্প হয়ে উঠেছে, তাই তেলের দাম ১০০ ডলারে ওঠা অসম্ভব কিছু নয়। পার্শ্ববর্তী দেশে জ্বালানি তেলের দাম বেশি থাকায় পাচারের বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। খবরঃ দৈনিক সময়ের আলোর।

আমাদের বাণী/বাংলাদেশ/২৯/১০/২০২১ 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.