
ঢাকাঃ যে ভ্যাকসিনের জন্য এত হাহাকার অবস্থা। সেই ভ্যাকসিন মিলছে সাধারণ কোনো এক ফার্মেসিতে! এতে লাগেনি নাম, নিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্র। টাকার বিনিময়ে দেওয়া হচ্ছিল মডার্নার মতো দামি ভ্যাকসিন।
বুধবার রাতে দক্ষিণখানে একটি ফার্মেসি থেকে মডার্নার ভ্যাকসিন জব্দসহ বিজয় কৃষ্ণ তালুকদার নামে একজন পল্লী চিকিৎসককে গ্রেফতারের ঘটনায় রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি কঠোর ব্যবস্থাপনার মধ্যেও কীভাবে ভ্যাকসিন পাচার হচ্ছে কিংবা সরানো সম্ভব হলো তা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। এর আগে সিরিঞ্জে ভ্যাকসিন না নিয়েই কেবল সুচ ফোটানোর মতো প্রতারণাসহ নানা ঘটনা ঘটেছে। ভ্যাকসিন নিয়ে আরও বেশ কিছু প্রতারণা ও লুকোচুরির ঘটনাও রয়েছে। ফলে এর আগেও ভ্যাকসিন পাচার হয়েছে কি না, এভাবে ‘খোলা বাজারে’ আরও আগে থেকেই ভ্যাকসিনের লেনদেন চলছিল কি না সেসব প্রশ্ন এখন জনমনে।
যদিও প্রাথমিক তদন্তের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, জব্দ করা ভ্যাকসিনগুলো গণটিকা কার্যক্রম পরিচালনাকালে পাচার করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে তার কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য জানতে গ্রেফতার বিজয় কৃষ্ণকে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করে দক্ষিণখান থানা পুলিশ। এরপর বিচারক আগামী ২৩ আগস্ট রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করে বিজয়কে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। গ্রেফতার বিজয় নিজেকে পল্লী চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এ ছাড়া সাম্প্রতিক গণটিকা কর্মসূচির আওতায় তিনি উত্তরার একটি কেন্দ্রে টিকাদান কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার খুরশীদ আলম বলেন, ঘটনা আমিও শুনেছি। তবে বিস্তারিত জানি না। তবে আমাদের যে সিস্টেম তাতে টিকা বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তারপরও আমরা এটা তদন্ত করে দেখছি। তিনি আরও বলেন, জব্দ করা ওইসব টিকা সত্যিই করোনার টিকা নাকি অন্য কিছু সেটাও তদন্ত করে দেখা হবে। এ ধরনের অভিযোগ এই প্রথম পাওয়া গেছে বলেও দাবি করেন তিনি।
পুলিশ জানিয়েছে, বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে দক্ষিণখান থানার চালাবন হাজী বিল্লাত আলী স্কুলের সামনের ‘দরিদ্র পরিবার সেবা’ নামে একটি ফার্মেসিতে অভিযান চালিয়ে মডার্না ভ্যাকসিনের ২০টি খালি বাক্স ও ২টি টিকার অ্যাম্পুলসহ বিজয়কৃষ্ণ তালুকদারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। উদ্ধার করা দুটি অ্যাম্পুলের মধ্যে একটি খালি অবস্থায় ফার্মেসি থেকে এবং আরেকটি আংশিক পূর্ণ অবস্থায় বিজয়ের বাসার ফ্রিজ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ আরও জানিয়েছে, ভ্যাকসিনের ভায়ালে সাধারণত টিকার ১৪ ডোজ টিকা থাকে। সে হিসেবে উদ্ধার করা বাক্সে অন্তত ২০০ অ্যাম্পুল ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভ্যাকসিনের ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্বে ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের বা মনোনীত কর্মকর্তারা। কিন্তু এই ভ্যাকসিন কীভাবে বাইরে ফার্মেসিতে চলে গেল তা নিয়ে গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর। ফলে এ ঘটনায় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারাও জড়িত কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সাইফুল ইসলাম বলেন, গ্রেফতার বিজয় প্যারামেডিকেল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তিনি গণটিকা কার্যক্রম শুরু হলে উত্তরখান এলাকার একটি কেন্দ্রে টিকাদানের সহায়তাকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে ২০টি খালি প্যাকেটের বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেননি। বিজয়কে গ্রেফতারের পর স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানিয়েছে, ‘টিকা বাইরে নেওয়ার সুযোগ নেই। এটা আসলেই টিকা কি না তা পরীক্ষা করা হবে।’ তবে জব্দ করা ভ্যাকসিনগুলো মডার্নার বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছেন গ্রেফতার বিজয়কৃষ্ণ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা টিকাদানের শুরুতেই এ ধরনের আশঙ্কার কথা বলেছিলাম। এবার তা সত্য প্রমাণ হলো। আমার মনে হয় দক্ষিণখানের মতো টিকা বাইরে যাওয়ার আরও ঘটনা আছে। এর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। টিকা নিয়ে যে অব্যবস্থাপনা তারই ফলাফল এটা।’
দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল হক মিয়া জানান, এক দম্পতি ৫০০ টাকার বিনিময়ে বিজয়ের কাছ থেকে ভ্যাকসিন নিয়েছেন- এমন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাকে আটকসহ এসব টিকা উদ্ধার করা হয়। তিনি বলেন, এসব টিকার উৎস জানার চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় দক্ষিণখান থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা হয়েছে। ফার্মেসি মালিক বিজয়কৃষ্ণকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।
আদালত প্রতিবেদক জানান, বৃহস্পতিবার দক্ষিণখান থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে আসামি বিজয়কৃষ্ণকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে হাজির করে পুলিশ। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মহানগর হাকিম আবু সাঈদ তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ২৩ আগস্ট রিমান্ড শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র ও গণমাধ্যমের তথ্যে দেখা গেছে, গত ৩০ ও ৩১ জুলাই চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে অনুমতি ছাড়াই বেশ কিছু টিকা সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রবিউল হোসেনের বিরুদ্ধে। রবিউল হোসেন রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে টাকার বিনিময়ে অন্তত দেড় থেকে দুই হাজার লোককে টিকা দেন বলে অভিযোগ ওঠে। সিনোফার্মের তৈরি একেকটি টিকা দুজনকে দেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে ৭০০-৭৫০টি টিকা দেওয়া হয়েছে দুদিনে। রবিউল হোসেনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে নিবন্ধন জালিয়াতি করে করোনার টিকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ৬০ জনের বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক।
এ ঘটনায় টিকা নিবন্ধনে জালিয়াতির অভিযোগে মো. মনিরুল ইসলাম (৪৫) নামে এক ব্যবসায়ীকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহরলাল হাজারির অফিসের এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে করোনার টিকা নিয়ে ভয়াবহ জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। টিকার সঙ্কটকে পুঁজি করে বলরাম চক্রবর্তী ওরফে বলাইয়া ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বাসায় বসে অর্থের বিনিময়ে মানুষকে নিজ হাতে টিকা দিয়েছেন! প্রতি ডোজের জন্য তিনি গ্রহীতার কাছ থেকে হাতিয়ে নেন এক থেকে দুই হাজার টাকা। গত ১৭ আগস্ট যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে করোনা টিকা গ্রহণ সংক্রান্ত ভুয়া সনদপত্রসহ মো. ইমরান হোসেন (২৫) নামের জালিয়াত চক্রের এক সদস্যকে আটক করেছে র্যাব-৩।
আমাদের বাণী/বাংলাদেশ/২০/০৮/২০২১
Leave a Reply