
ঢাকাঃ মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সেই তাণ্ডবের কথা হয়তো কেউই ভোলেনি। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজত কর্মীরা অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরের পাশাপাশি থানায় দায়িত্বরত পুলিশের ওপর হামলাও চালিয়েছিলেন। সেই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করে। কিন্তু সাত বছরেও সেই মামলার অভিযোগপত্র দিতে পারেনি পুলিশ। পুলিশের বক্তব্য, এই অভিযোগপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে।
শুধু এই ঘটনা নয়, অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতারাই ঠিক করে দিচ্ছেন পুলিশ কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে আর কার বিরুদ্ধে নেবে না। তবে রাজনৈতিক নেতাদের এই হস্তক্ষেপ নিয়ে পুলিশ মোটেই খুশি নয়। সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর ‘বাংলাদেশ পুলিশের সংস্কার ও উন্নয়নে মাঠপর্যায়ের মতামত ২০২০’ শিরোনামের এক জরিপে সেই চিত্র ফুটে উঠেছে। জরিপে কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পদবির ৪১১ জন পুলিশ সদস্যের মতামত নেওয়া হয়। এতে ৮টি রেঞ্জ, ৮টি মেট্রোপলিটন পুলিশ, পার্বত্য অঞ্চলসহ ৬৪ জেলা ও বিশেষায়িত ইউনিটের পুলিশ সদস্যরা অংশ নেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের এই মতামতের ব্যাপারে জানতে চাইলে আশ্বাসের কথা জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমাদের কাছে তো আর আশ্চর্য প্রদীপ নেই। যে ঘষা দিলাম আর অমনি জিন এসে সব ঠিক করে দিল। আমরা ধীরে ধীরে কাজ করছি। কাজ হচ্ছে-পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। অপেক্ষা করেন যতটা হয়েছে, আরও হবে।’
জরিপে দেখা গেছে, পুলিশ সদস্যরা মনে করেন, পুলিশের প্রচলিত যে পাঁচটি চর্চা আছে, তা পরিত্যাগ করা উচিত। তার মধ্যে অন্যতম হলো, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি। মামলার তদন্তে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, মামলা না নিতে চাপ, আসামি ছাড়তে তদবির, স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা, নিয়োগ-পদোন্নতিসহ নানা বিষয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় তাঁদের। অংশগ্রহণকারী পুলিশ সদস্যরা বলেন, পুলিশের এই রাজনৈতিক ব্যক্তিনির্ভর চর্চা থেকে বের হয়ে আসা উচিত।
এই মতামতে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পক্ষ থেকে বলা হয়, পুলিশ সদস্যদের রাজনীতি, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পেশাদার কর্মকাণ্ডের বাইরে অন্য সব কর্মকাণ্ডে যুক্ত হলে পুলিশেরও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। এ ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরি আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এ বছরের শুরুতে যশোর-৬ আসনের সাংসদ প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ‘বোমা’ মারতে থানার ওসিকে ফোনে নির্দেশ দেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সেই কেশবপুর থানার ওসি জসিম উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ভালো পুলিশিং করতে হলে রাজনৈতিক চাপমুক্ত থাকা দরকার।
কিন্তু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ অন্য কথা বলেছেন। তিনি বলেন, পুলিশ তার কাজে রাজনৈতিকভাবে কোনোভাবেই আবদ্ধ নয়। তাদের কোনো কাজে বাধা দেওয়া হয় না।
তবে আওয়ামী লীগের এই নেতার সঙ্গে একমত নন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি মনে করেন, ক্ষমতাসীন দল পুলিশকে তাদের কাজে ব্যবহার করছে। এটার অবসান হওয়া দরকার।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক নেতারা যাই বলুন না কেন, কোনো সরকারই পুলিশকে মুক্ত করে দিতে চায় না। যারা বিরোধী দলে যায়, তারা পুলিশকে স্বতন্ত্রভাবে দেখতে চায় আবার সরকারি দলে ফিরলে ভুলে যায়। আসলে পুলিশের জন্য এমন আইন হওয়া উচিত, যাতে পুলিশ সবার কথাই শুনবে, কিন্তু কারও অন্যায় আবদার মানবে না।
নিয়োগে রাজনৈতিক চাপ পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল নিয়োগের অধিকর্তা হলেন জেলার পুলিশ সুপার (এসপি)। সেই নিয়োগে জেলার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, মন্ত্রী-এমপিসহ অনেকেই তদবির করে থাকেন। পুলিশ সদর দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলেন, প্রত্যেক নিয়োগেই পুলিশ সদর দপ্তর থেকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী বা মন্ত্রী-এমপিদের অনৈতিক তদবির এড়িয়ে চলতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেটা অনুসরণ সম্ভব হয় না।
নিয়োগের বিষয়ে স্বচ্ছতা আনতে করণীয়ের বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরকে এটিইউ, এসবি, এপিবিএনসহ অন্তত ২০টি জেলা পুলিশ বলেছে, নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিকসহ সব ধরনের অপেশাদার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকাটা দরকার।
মামলা নিতে চাপ, গত মার্চে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের এক ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া শ্রমিক লীগের নেতা আলাউদ্দিনের ভাই এমদাদ হোসেন। তিনি বলেন, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের বিবদমান দুপক্ষের বিরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা সঠিক ছিল না। এমদাদ হোসেন অভিযোগ করে বলেন, ‘থানার ওসি ও জেলার এসপি বলেছেন আসামিদের মধ্যে থেকে বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার নাম বাদ দিলেই মামলা নেবেন তাঁরা। কিন্তু পুলিশের কথায় রাজি না হয়ে ১৬৪ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা দায়ের করি। মামলাতে মেয়র আবদুল কাদের মির্জা, তাঁর ভাই শাহাদাত হোসেন ও ছেলে মির্জা মাসরুর কাদের তাসিককে আসামিও করেছি।’
রাজনীতিবিদ আসামি হলে মামলা কেন নিতে চায় না পুলিশ জানতে চাইলে সে সময়ের দায়িত্বে থাকা নোয়াখালীর এসপি আলমগীর হোসেন বলেন, কোম্পানীগঞ্জের পরিস্থিতিতে পুলিশ নিজের মতো কাজ করতে পেরেছে। মামলা নেওয়া বা আসামি করাতে কোনো রাজনৈতিক চাপ ছিল কি না, এ ধরনের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এমন কিছু আমার জানা নাই।’
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘আইনপ্রণেতাদের নীতিনৈতিকতার জায়গাটা আরও শক্ত হওয়া উচিত। জনপ্রতিনিধি যদি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত না হন, তাহলে তিনি জবাবদিহি বা স্বচ্ছতার ঊর্ধ্বে উঠে যান। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আমরা সেই সময় অতিক্রম করছি।’
রাজনীতিবিদদের অন্যায় আবদার শুনতে পুলিশ বাধ্য কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ পুলিশের মুখপাত্র এআইজি সোহেল রানা বলেন, পুলিশ সদর দপ্তর মনে করে, পুলিশের কাজে বাহ্যিক কোনো প্রভাবের সুযোগ নেই। কোনো কর্মকর্তা বা সদস্য যদি বাহ্যিক কোনো প্রভাবকের অজুহাতে পেশাগত ও আইনসম্মত সেবা দিতে ব্যর্থ হন, তার দায় তাঁকেই নিতে হবে।
সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক মনে করেন, যেসব বিষয়ে রাজনীতি জড়িত থাকে, সেসব বিষয়ে হয়তো পুলিশ তার জায়গা থেকে কাজটা স্বাধীনভাবে করতে পারে না। এটা অবশ্য এক দিনে হয়নি। রাতারাতি সেটা বদলানো যাবে না। তবে এটা ঠিক যে, সবাইকে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আমাদের বাণী/বাংলাদেশ/২০/০৮/২০২১
Leave a Reply