হিজড়াদের দাপটে বিপাকে নগরবাসী

ঢাকাঃ হিজড়াদের বাড়াবাড়ি যেন আগের সব সীমাকে ছাড়িয়ে গেছে। তাদের উপদ্রব থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউ। রাজধানীর বাসস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন স্থানে হিজড়াদের চাঁদাবাজির ঘটনা আবার শুরু হয়েছে। নাজেহাল হচ্ছে যাত্রীরা। বাসাবাড়িতে নববিবাহিত দম্পতি অথবা সদ্যোজাত শিশুর বাড়ি থেকে, দোকান থেকে নগদ অর্থ আদায়ে ঝগড়াঝাঁটির ঘটনা ঘটছে অহরহ। চাহিদামতো টাকা না পেলে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করছে তারা।

করছে কদর্য অঙ্গভঙ্গি। করোনায় গেল কয়েক মাস এসব সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। হিজড়াদের একটি বড় অংশ যৌনবৃত্তিতে সম্পৃক্ত। লকডাউনের কারণে উপার্জনের সে রাস্তাও বন্ধ ছিল। এখন ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে আবার তা শুরু হয়েছে।

স্কুলশিক্ষক শফিক আহমেদ বনানী থেকে গাজীপুর যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে আবদুল্লাহপুর সিগন্যালের জ্যামে পড়েন তিনি। এ সুযোগে লাল রঙের লিপস্টিক, কপালে বড়সড় টিপ আর কড়া মেকআপ করা চার-পাঁচজন হিজড়া গাড়িতে ওঠে। বিভিন্ন বয়সের এ হিজড়ারা বাসে ঢুকেই জোরেশোরে হাততালি ও নানা অঙ্গভঙ্গি শুরু করে। তিনি স্বল্প টাকা দিয়ে বাঁচলেও হিজড়াদের নাজেহাল থেকে রেহাই পাননি পাশের সিটে বসা রেদোয়ান শুভ রনি। বেসরকারি চাকুরে রনি জানান, কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক হিজড়া তার অণ্ডকোষ চেপে ধরে। মুখের মাস্ক খুলে ফেলে অপদস্থ শুরু করে। দাবি অনুযায়ী টাকা আদায়ে এক হিজড়া পরনের কাপড় উঠিয়ে ফেলে। লোকলজ্জার ভয়ে আড়াইশ টাকা দিয়ে নিস্তার পান তিনি। ওই বাসের প্রায় সব যাত্রীর কাছ থেকে রীতিমতো অসভ্য আচরণ করে ২০০-২৫০ টাকা হাতিয়ে নেয় এই হিজড়ার দল।

রাজধানীর কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, করোনার মধ্যে কয়েক মাস নিস্তার থাকলেও ফের বেড়েছে হিজড়াদের উৎপাত। হিজড়ারা বলছে, ঘরে খাবার সঙ্কট বেড়ে যাওয়ায় আবার তারা রাস্তায় নেমেছে। করোনার কারণে অনেক দিন তারা ঘরে বন্দি ছিল। টাকা না তুলে তাদের এখন উপায়ও নেই। করোনা নিয়েও তেমন উদ্বিগ্নতা দেখা যায়নি হিজড়াদের। স্বাস্থ্যবিধি মানতে গেলে তাদের পেট চলবে না। অন্যদিকে টিকা নিবন্ধনের সুরক্ষা অ্যাপসে হিজড়াদের কোনো ক্যাটাগরি নেই। সুযোগ থাকলে টিকা নিতে চান বলে জানান একাধিক হিজড়া।

তেজগাঁও এলাকার রূপবান হিজড়া বলেন, আসলে টাকা না তুললে বা রাস্তায় না নামলে আমরা কী করে খাব? আমাদের তো কেউ কাজ দেয় না। করোনায় অনেকের বাসায় খাবার ছিল না। পথচারীদের সঙ্গে বাড়াবাড়ি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের গুরুমার নির্দেশ কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ না করার। মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে যা দেয় তা নিয়ে আসা। কিন্তু আমরাই খারাপ ব্যবহার করি। আমাদের মধ্যে দুয়েকজন একটু অসভ্য থাকে। অনেক সময় আমাদের সঙ্গেও খারাপ আচরণ করা হয়।

ঈদের আগে রাত ৯টার দিকে রাজধানীর সাতরাস্তার সিগন্যাল থেকে উইনার পরিবহনে ওঠে তিন হিজড়া। প্রথমে তাদের আচরণ কিছুটা নমনীয়ই ছিল। ‘ওই ভাইয়া-মামারা তোমরা যে যা পার দিয়ে দাও’– এমন কথা বলে সবার কাছ থেকে ১০-৫ টাকা নিয়ে চলে যাওয়ার সময় বাড়াবাড়ি করে তারা। গাড়ির একেবারে পেছনের সিটে বসা ছিল প্রায় একই বয়সের যুবক। তারা কেন হাসল, এ কারণে আবার দুই হিজড়া জোরাজুরি করে ১২০ টাকা আদায় করে ছাড়ে।

রাজধানীর স্মার্ট উইনার পরিবহনের একজন সহকারী বলেন, যাত্রীদের কথায় বাধ্য হয়ে বাসের গেটলক করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে নাবিস্কোর দিক থেকে ৭-৮ জন হিজড়া ইট ছুড়ে মারে। ইটে জানালার গ্লাস ভেঙে যাত্রী আহত হয়। পরে আমাকে না পেয়ে ড্রাইভারকে বেধড়ক মারধর করে তারা। হিজড়াদের বাড়াবাড়ি যেন আগের সব সীমাকে ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশ হিজড়া কল্যাণ পরিষদের চেয়ারম্যান আবিদা সুলতানা মিতু সময়ের আলোকে বলেন, প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণেই হিজড়াদের নিবৃত করা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ছত্রছায়ায় তাদের উচ্ছৃঙ্খলতার মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। তারা কাউকে মানে না। কারণ হিজড়াদের মাধ্যমে সবাই সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে।

সচেতন সমাজসেবা হিজড়া সংঘের নির্বাহী পরিচালক ইভান আহমেদ বলেন, আসলে বাসে বা অন্য কোথা থেকে টাকা তোলাটা হিজড়াদের কোনো পেশা না। আমরা কোনো কাজ না পেলে এ ধরনের পথ বেছে নিই। সরকারের আমাদের বিষয়ে আরও একটু সংবেদনশীল হওয়া উচিত।

তবে পুলিশ বলছে, তারা চেষ্টা করছেন হিজড়াদের নিয়ন্ত্রণ করতে। এক্ষেত্রে দ্রুত সাহায্য পেতে ৯৯৯-এ কল করার পরামর্শ দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ডিআইজি) হাবিবুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, হিজড়ারা রূঢ় ব্যবহার করলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন যে কেউ।

সমাজসেবা অধিদফতরের জরিপ মতে, দেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজারের কিছু বেশি। তবে হিজড়া সংগঠনগুলোর দাবি, এ সংখ্যা অর্ধ লক্ষাধিক। আর সাধারণ হিজড়াদের দাবি, তাদের সংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি হবে।

২০২১ সালের শুরুতে জনশুমারিতে নারী-পুরুষের পাশাপাশি হিজড়াদের আলাদা লিঙ্গ পরিচয়ে যুক্ত করার কথা জানিয়েছিল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মহাপরিচালক মোহাম্মাদ তাজুল ইসলাম। তবে মহামারি দুর্যোগে তা আর সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ পুলিশের ডিআইজি ও হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন উত্তরণ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, লৈঙ্গিক স্বীকৃতির পর জনশুমারিতে সংযুক্ত করা হবে হিজড়া জনগোষ্ঠীর একটি বড় অর্জন। হিজড়াদের সঠিক সংখ্যা জানা গেলে, তাদের জীবনমান উন্নয়ন আরও দ্রুততর হবে।

আমাদের বাণী/বাংলাদেশ/১৪/০৮/২০২১

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.