
ঢাকাঃ পুলিশ সদস্যদের অপরাধে জড়ানোর ঘটনা কমছে না। একের পর এক অপরাধ করেই যাচ্ছে তারা। অথচ তাদের অপরাধ প্রতিরোধে গঠিত হয়েছে আইজিপিস কমপ্লেইন সেল। যেখানে প্রতিদিন শত শত পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ জমা পড়ছে। চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ, অপহরণ, খুন, ছিনতাই, নির্যাতন, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পুলিশ সদস্যদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। অনেককে নানা লঘুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে।
পুলিশের তথ্য বলছে, প্রতিবছর গড়ে ২ হাজার পুলিশ সদস্য বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার কারণে চাকরি হারাচ্ছে। এসবের পরও পুলিশের অপরাধে জড়ানো ঠেকানো যাচ্ছে না। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে ডিবির সাবেক এক এডিসির সঙ্গে পরীমণির কথিত প্রেম ও ফেনীতে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে স্বর্ণের বার ছিনতাইয়ের ঘটনা। এই দুই ঘটনার বাইরেও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, পুলিশ সদস্য কর্তৃক নারী সহকর্মীরা হয়রানি ও যৌন নির্যাতনের শিকার অন্যতম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশ সদস্যদের মাঝে জবাবদিহিতা না থাকা ও কঠোর শাস্তি না হওয়ায় বারবার এমন ঘটনা ঘটছে। তবে তারা পুলিশের অপরাধ থেকে ফেরানোর জন্য তাদের সংস্কৃতিতে পরিবর্তন, ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া এবং কোনো না কোনোভাবে কমিউনিটি পুলিশিংয়ে সিভিল সোসাইটির সম্পৃক্ততা বাড়ানো হলে অপরাধ অনেকাংশে কমে আসবে বলে মনে করছেন তারা। এ ছাড়াও তাদের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তবে পুলিশের কর্মকাণ্ড দেশব্যাপী দেখার জন্য পুলিশের যে একটি সংস্থাটি রয়েছে তাদের কাজের গতি বাড়াতে হবে। যাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে তাদের তৎপরতা কাজে লাগানো যায়।
স্ত্রীকে ভাড়াটিয়া কিলার দিয়ে হত্যার ঘটনায় আলোচনায় আসে সাবেক এসপি বাবুল আক্তার, নারী কেলেঙ্কারিতে সাবেক ডিআইজি মিজান ও সর্বশেষ ফেনী জেলার ডিবির ওসিসহ সাত জনের বিরুদ্ধে স্বর্ণ লুটপাটে জড়িত থাকা ও গ্রেফতারের ঘটনা ছাড়াও জাতিসংঘ মিশনে এক নারী সহকর্মীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে বাগেরহাটের পিবিআইয়ের জেলা পুলিশ সুপার মোক্তার হোসেনের বিরুদ্ধে। যদিও তার বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি রাজশাহীর বোশপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করে স্বামীর নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ বিচার চাইতে গিয়ে উল্টো যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তার মাধ্যমে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মো. শামীমকে সোমবার প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে এসব ঘটনা পুলিশকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। ফলে পুলিশ বড় ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে।
পুলিশের সাবেক আইজিপি শহীদুল হক বলেন, একজন সাধারণ পাবলিকের অপরাধের চেয়েও বাহিনীর কেউ অপরাধে জড়ালে সেই অপরাধকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। এ কারণে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সেই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। কেন বন্ধ হচ্ছে না পুলিশের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা এবং এটি প্রতিরোধে কী ধরনের পদক্ষেপ দরকার জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, এটা বন্ধ করতে হলে এখন যেমন গ্রাসটিক অ্যাকশন নেওয়া হয়েছে সেটি অব্যাহত রাখতে হবে। এ ছাড়াও নজরদারি বাড়াতে হবে। যারা তদারকি অফিসার হিসেবে আছেন তাদের তদারকির পাশাপাশি মোটিভেশনাল কাজটি বাড়াতে হবে। তদারকি ও সাজা অব্যাহত রাখতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. জিয়া রহমান বলেন, পুলিশ বাহিনীর পুরো ব্যবস্থাটা ঔপনিবেশিক কাঠামোর মধ্যে চলছে। যদি এই কাঠামো বা ব্যবস্থাটা পরিবর্তন না করা যায় তবে যতই কথা বলি না কেন কোনো লাভ হবে না। পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে যে প্রশিক্ষণ দরকার সেখানে দুর্বলতা রয়ে গেছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এই দুটো পুলিশে নেই বললেই চলে।
পুলিশের ইমেজ যে সঙ্কট পুনরুদ্ধার ও তাদের অপরাধ থেকে ফেরাতে তিনি মনে করেন, কমিউনিটি পুলিশের তৎপরতা বাড়ানো গেলে সিভিল সোসাইটির সম্পৃক্ততা বাড়বে। ফলে তার মাঝে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা কমে যায়। এ ছাড়াও মিড পর্যায়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এলিটদের মধ্যে ওই পুলিশ সদস্যের যে রসায়ন তৈরি হয়েছে অপরাধ জগতের ক্ষেত্রে সেটাকে আগে ভাঙা দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক, সমাজ অপরাধ ও বিশ্লেষক তৌহিদুল হক মনে করেন, রক্ষক যদি ভক্ষক হয় তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের একটা বিশ্বাসের ঘাটতি হয়। পুলিশের মতো একটি বাহিনীতে নৈতিক মানদণ্ড ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তার কর্মকাণ্ড মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা এবং তাদের বিরুদ্ধে অপরাধগুলোর বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে তা কমিয়ে আনা সম্ভব।
পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া বিভাগের এআইজি সোহেল রানা বলেন, পুলিশের কোনো সদস্য অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্যকে বিভিন্ন মাত্রায় শাস্তির আওতায় আনা হয়। সুত্রঃ পুলিশ
আমাদের বাণী/বাংলাদেশ/১৩/০৮/২০২১
Leave a Reply