বজ্রপাতে একসাথে অনেক মানুষের মৃত্যু হয় কীভাবে

বজ্রপাত

বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা।এতে সারা বিশ্বে বছরে ২৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। বজ্রপাতের কারণে প্রায়শই মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বেশিরভাগ সময় বিচ্ছিন্নভাবে এক দুইজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। আবার কখনো কখনো একটিমাত্র বজ্রপাতে বহু মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটে থাকে। যেমন এবছরের অগাস্ট মাসের শুরুতে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জে বরযাত্রী দলের ওপর বজ্রপাতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বজ্রপাতে বাংলাদেশে ঠিক কতো মানুষের মৃত্যু হয় তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংগৃহীত তথ্য থেকে ধারণা করা যায় এই সংখ্যা দেড়শ থেকো দুশোর মতো। বার্ষিক প্রাণহানির এই সংখ্যার বিচারে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।

অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে এই প্রাকৃতিক ঘটনার ওপর গবেষণা চালিয়েছে। তারা বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয় যার ৭০ শতাংশই হয় এপ্রিল থেকে জুন মাসে।

তাদের গবেষণা বলছে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মারা গেছে ১ হাজার ৮৭৮ জন এবং তাদের ৭২ শতাংশই কৃষক।

কীভাবে মানুষের মৃত্যু হয়
বজ্রপাতের কারণে মূলত দুটি উপায়ে মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে। একটি কারণ প্রত্যক্ষ বা সরাসরি আঘাত যা মানুষের শরীরের ওপর সরাসরি পড়ে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে পরোক্ষ আঘাত।

সরাসরি আঘাতে মানুষের মৃত্যুর হার অনেক কম। এধরনের ঘটনা খুব কমই ঘটে থাকে।

কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও গবেষক ড. আশরাফ দেওয়ান বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী যত মানুষের মৃত্যু হয় তার মধ্যে সবচেয়ে কম মৃত্যু হয় প্রত্যক্ষ আঘাতের কারণে। এটি দুর্লভ ঘটনা। বেশিরভাগ মৃত্যুই হয় পরোক্ষ আঘাতের কারণে।’

তিনি জানান, পরোক্ষ আঘাতও কয়েক ধরনের হয়ে থাকে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে- যেখানে বজ্রপাত আঘাত হানছে সেখানকার পুরো জায়গাটি বিদ্যুতায়িত হয়ে যাওয়া। একে বলা হয় ভূমির বিদ্যুতায়ন। এভাবেই সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে।

‘বজ্রপাত ভূপৃষ্ঠের যে স্থানে আঘাত করে সেখান থেকে বিদ্যুৎ ভূমির সকল দিকে চলাচল করতে পারে। মোটামুটি তিন কিমি এলাকা বিদ্যুতায়িত হতে পরে। কেউ যদি বজ্রপাতের লক্ষ্যের কাছাকাছি থাকে, তবে ভূমির বৈদ্যুতিক প্রবাহে তার মৃত্যু হতে পারে। আর যদি বজ্রপাতের সময় ভূমি আর্দ্র থাকে এবং সেখানে যারা থাকবে তাদের মৃত্যু-ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে,’ বলেন তিনি।

আরেকটি উপায় হচ্ছে সাইড ফ্ল্যাশ বা পার্শ্বীয় ঝলকানি। বজ্রপাতের সময় কেউ যদি কোনো গাছের নিচে থাকে, তখন বজ্রপাত ওই গাছে আঘাত করে এবং বিদ্যুতের কিছু অংশ তার শরীরে পরিবাহিত হয়েও মৃত্যু হতে পারে।

একসাথে বহু মানুষের মৃত্যু হয় কেন

বজ্রপাতের আঘাতে কখনো কখনো একসাথে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। সম্প্রতি ৪ঠা অগাস্ট বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি বরযাত্রী দলের ওপর বাজ পড়লে ১৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। এরা সবাই বৃষ্টির কারণে একটি ঘরের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিল।

একটি বজ্রপাতের ঘটনায় একসাথে এতো মানুষের মৃত্যু সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভূমির বিদ্যুতায়ন এবং সাইড ফ্ল্যাশ- এই দুটোর যেকোনো একটি অথবা তাদের সম্মিলিত কারণেও এরকম হয়ে থাকতে পারে।

পরিবেশ বিজ্ঞানী আশরাফ দেয়ান বলেন, ‘ধারণা করছি ভূমির বিদ্যুতের সাথে পার্শ্বীয় ঝলকানির সম্মিলিত প্রভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এতো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যেহেতু বজ্রপাতের সাথে বৃষ্টি হচ্ছিল সেহেতু ভূমি আর্দ্র ছিল। পানি বা আর্দ্রতা যেহেতু বিদ্যুৎ পরিবাহী, সেহেতু ভূমির কারেন্টে তাদের মৃত্যু হতে পারে। এছাড়াও ছাউনিতে হয়তো বজ্র-নিরোধক কোনো ব্যবস্থাও ছিল না।’

তিনি বলেন, বজ্রপাতের কারণে কখনো কখনো যে স্টেপ ভোল্টেজ তৈরি হয় সেটা বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ওই স্থানে যারা অবস্থান করে তাদের সবাই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যতে পারে।

বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতোখানি
বজ্রপাত আঘাত করার পরেও কারো বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে কীনা সেটা নির্ভর করে বজ্রপাতের সময় ওই ব্যক্তি কোথায় ছিলেন তার ওপর। বজ্রপাতের লক্ষ্য থেকে তিনি কতোটা দূরে ছিলেন, শরীরের কতোটা অংশ পুড়ে গেছে- এরকম অনেক কিছুর ওপরেই এটি নির্ভর করে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণত পানির ওপরে থাকলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। কারণ পানি বিদ্যুৎ পরিবাহী।

বজ্রপাতের আঘাতে মানুষের শরীর পুড়ে যায়। তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে। শকওয়েভ সাউন্ড বা প্রচণ্ড শব্দের কারণে মানুষ পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে যেতে পারে। নার্ভ সিস্টেম বা স্নায়ুতন্ত্র পুরোটাই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

এছাড়াও আরো নানা ধরনের দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হতে পারে যার মধ্যে রয়েছে মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা, স্মৃতি-ভ্রম ইত্যাদি। সারা বিশ্বেই বজ্রপাতের আঘাতের পরেও বহু মানুষের বেঁচে যাওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে।

গবেষক ড. আশরাফ দেওয়ান বলেন, ‘কেউ বৈদ্যুতিক শক পেলে আমরা যেমন তাকে চিকিৎসা দেই, সেরকম চিকিৎসা সাথে সাথে দেওয়া গেলে বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিকেও বাঁচানো সম্ভব।’

কোথায় কোথায় বজ্রপাত বেশি হয়
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ১৯৯৫ সালে একটি স্যাটেলাইট পাঠিয়েছিল যা দিয়ে বজ্রপাতের তথ্য রেকর্ড করা হতো।

নাসার ১৭ বছরের ওই তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশরাফ দেয়ান। এর পরে ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্য নিয়েও তারা আরো একটি গবেষণা চালিয়েছেন।

এই দুটো গবেষণাতেই দেখা গেছে বাংলাদেশে বজ্রপাত মওসুম নির্ভর। আশরাফ দেয়ান বলেন, প্রাক মওসুমে অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় হাওর অঞ্চলে: নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেটে।

মওসুমি সময়ে বজ্রপাত বেশি হয় সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, বরিশাল এবং উত্তরবঙ্গের রংপুর, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামে।

মওসুমি-উত্তর অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বর মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী এসব অঞ্চলে বেশি হয় শীতকালে।

‘বজ্রপাত খুবই স্থানীয় একটি ঘটনা। বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় যেমন বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে হয় বজ্রপাতের বেলায় সেরকমটা ঘটে না,’ বলেন দেওয়ান।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, আবহাওয়ার নানা ফ্যাক্টরের কারণে একেক অঞ্চলে একেক সময়ে বজ্রপাত কম বেশি হয়ে থাকে।

‘এক্ষেত্রে ভৌগলিক অবস্থান অনেক গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর এবং পূর্ব দিক দিয়ে বাংলাদেশ হিমালয় দ্বারা পরিবেষ্টিত। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত হওয়ার কারণে এখানে বজ্রপাত হওয়ার পরিবেশগত নিয়ামক বেশি থাকে।’

এছাড়াও ভূমি ও পরিবেশের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর এটি নির্ভর করে। এর পেছনে জলবায়ুর পরিবর্তন এবং বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকেও একটি কারণ বলে মনে করছেন অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আশরাফ দেওয়ান। সূত্র : বিবিসি

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.