তিন বেলার খাবার জোটানোই দায়

শফিকুল ইসলাম চাকরি করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বসবাস করেন রাজধানীর পশ্চিম পীরেরবাগে। তিন সন্তান, বৃদ্ধা মা এবং স্ত্রীসহ তার ছয়জনের সংসার। বেতন পেতেন মাসে ৩০ হাজার টাকা। বেতনের টাকা দিয়েই বেশ চলে যাচ্ছিল সংসার। চাকরিটি হঠাৎ চলে যায় গত মার্চ মাসে।

মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। একবার ভেবেছিলেন, সব ছেড়ে-ছুড়ে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে চলে যাবেন। সন্তানরা লেখাপড়া করছে ঢাকায়, গ্রামে গেলে তাদের ক্ষতি হবে এ চিন্তা থেকে সিদ্ধান্ত বদলে থেকে যান ঢাকাতেই। কিন্তু কীভাবে সংসার চলবে, ঘর ভাড়াই বা কীভাবে দেবেন সে চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েন তিনি। সিদ্ধান্ত নেন, মহল্লায় সবজির ব্যবসা করবেন। এক আত্মীয়ের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ধার নিয়ে সবজির দোকান দেন। মাস শেষে দেখা যায় তার আয় কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। চলমান কঠোর লকডাউনে বেলা ৩টা পর্যন্ত দোকান খুলতে দিচ্ছে স্থানীয় কমিশনার। ফলে এখন বিক্রি আরও কমে গেছে। শফিকুল ইসলাম জানান, পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে ছয়জনের মুখের তিন বেলার খাবার জোটানোই দায় হয়ে গেছে। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা স্বল্প আয়ের মানুষ, আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোক। আমাদের আত্মসম্মানবোধ বেশি।

পেটে ক্ষুধা থাকলেও কারও কাছে হাত পাততে পারি না। তাই খেয়ে, না খেয়ে এখন কোনোরকম বেঁচে আছি।’ শুধু এই শফিকুল ইসলাম নন, তার মতো হাজারো লাখো মানুষের প্রায় একই দশা। মহামারি করোনা তাদের আয় কমিয়ে দিয়েছে, মুখের আহার কেড়ে নিয়েছে। পেটের ক্ষুধায় অনেকে ঢুকরে কেঁদে উঠছেন। এসব নিম্ন আয়ের ও আয় কমে যাওয়া মানুষের কষ্টের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে চাল, তেল, সবজি, মাছ, মাংসসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। এসব মানুষের আয় কমেছে ৫৫ শতাংশের ওপরে। অন্যদিকে চালসহ নিত্যপণ্যের বেড়েছে গড়ে ২০-৫০ শতাংশের ওপরে।

সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য মতে গত এক বছরে চিকন চালের দাম বেড়েছে ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ, মাঝারি চালের দাম বেড়েছে ১২ দশমিক ৭৭ শতাংশ, নিম্ন আয়ে মানুষেরা যে মোট চাল খায় তার দাম বেড়েছে ১৪ দশমিক ১২ শতাংশ। আটা-ময়দার দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ, খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ, ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৪৩ দশমিক ১৬ শতাংশ, ১ লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৪১ দশমিক ৪৬ শতাংশ, প্রতি লিটার পামঅয়েলের দাম বেড়েছে ৫৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এ ছাড়া অন্য কয়েকটি নিত্যপণ্যের মধ্যে আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, দেশি পেঁয়াজের ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ, আমদানিকৃত রসুনের দাম বেড়েছে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ, হলুদের দাম বেড়েছে ৫১ দশমিক ৭২ শতাংশ, তেজপাতার দাম বেড়েছে ২৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ, মার্কস গুঁড়ো দুধের দাম বেড়েছে ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, চিনির দাম বেড়েছে ১৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং লবণের দাম বেড়েছে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের গত বছরের ব্যবধানের পণ্যমূল্য বৃদ্ধির চিত্রেই বোঝা যায় কি হারে দাম বেড়েছে নিত্যপণ্যের। সাধারণ বাজারের মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে মূল্যবৃদ্ধির এ চিত্রের সঙ্গ বেশ তফাত থাকে সবসময়। যেসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তার প্রায় প্রতিটিই মানুষের প্রতিদিনকার প্রয়োজনীয় পণ্য। আর নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই করোনাকালের মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। এমনটিই মনে করছেন বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা।

এ বিষয়ে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দেশের সাধারণ মানুষ খুবই কষ্টে আছে। বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের কষ্টের মাত্রাটা বেশি। কারণ ধনীদের টাকার অভাব নেই, চালের কেজি ৫০০ টাকা হলেও তাদের কিছু যায়-আসে না। একেবারে যারা গরিব-অসহায় মানুষ তারা হয়তো সরকারি বা বিভিন্ন ব্যক্তি পর্যায়ের সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছে বা না পেলেও তারা মানুষের কাছে হাত পেতে কিছু না কিছু পাচ্ছে।

কিন্তু মধ্যবিত্ত না খেয়ে থাকলেও আত্মসম্মানবোধের কারণে তারা কারও কাছে হাত পাতবে না। এই শ্রেণির মানুষের কষ্ট আসলেই বেড়েছে। এজন্য সরকারের উচিত এই দুঃসময়ে পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা, নতুবা যেসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেশি সেগুলো কম মূল্যে আরও বেশি করে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া।

সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) করোনাকালে মানুষের আয় কমা ও দরিদ্র মানুষ কেমন বেড়েছে তার একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয়, করোনায় আয় কমেছে দেশের ৫৫ দশমিক ৯ ভাগ পরিবারের। আর করোনা মহামারির সময় দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ।

জরিপের ফল অনুযায়ী, করোনায় দারিদ্র্য হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। ২০১৮ সালে জিইডি-সানেমের জরিপে যা ছিল ২১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০১৬ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা জরিপ অনুসারে দারিদ্র্য হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। জরিপে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সব ধরনের কর্মসংস্থানে গড় আয় হ্রাস পেয়েছে, যা স্বনিযুক্তদের জন্য ৩২ শতাংশ, বেতনভিত্তিক কর্মীদের জন্য ২৩ শতাংশ, দিনমজুরের জন্য ২৯ শতাংশ এবং অন্যদের জন্য ৩৫ শতাংশ।

তবে সঙ্কট মোকাবিলার জন্য তারা বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বল করেছে। ৪৮ দশমিক ৭২ শতাংশ ঋণ নিয়েছে, ৩২ দশমিক ৪ শতাংশ সঞ্চয়ের ওপর নির্ভরশীল, ২৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ খাদ্য-ব্যয় কমিয়েছে, ২৭ শতাংশ তাদের খাদ্য তালিকায় অনিচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে এবং ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বন্ধু বা আত্মীয়ের কাছ থেকে অনুদান নিয়েছেন। এসব চিত্র বলে দেয় মানুষের আয় কি পরিমাণে কমেছে এবং জীবন বাঁচাতে এসব মনুষকে এখন কতটা সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নতুন করে দরিদ্র হওয়া এবং আয় কমে যাওয়া মানুষগুলো পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এখন কষ্টে আছে। তারা যথাযথ সহায়তা পাচ্ছেন না। করোনা কতদিন থাকবে সেটি আমরা কেউ জানি না। তাই এসব মানুষের জন্য সরকারকে আরও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। স্বল্প আয়ের মানুষের মতো মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্যও সরকারকে কোনো বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.