এডিস মশার ভয়ঙ্কর থাবা

ডেঙ্গু

বছরের শুরুতে কিছুটা ঝিম মেরে থাকলেও জুন থেকে ‘দাপট’ দেখাতে শুরু করে এডিস মশা। তাতে বাড়ছে ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তার। ২০১৯ সালে মহামারি পর্যায়ে চলে যায় ডেঙ্গু। সেই সময় ডেঙ্গু নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ, স্থানীয় সরকার ও দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে ঠেলাঠেলি মনোভাব এবং দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। আর এডিস মশাকে বাগে আনতে ঢাকাসহ দেশের ১১টি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে ঘাম ঝরাতে হয়েছে। সেই বছরও বছরের শুরুতেই ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কার কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু তা আমলে নেয়নি সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দপ্তরগুলো। চলতি বছরেও আগে থেকেই এডিসের বিস্তার বেড়ে যাওয়ায় ডেঙ্গুর আশঙ্কার কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দপ্তরগুলো সেই বার্তাও আমলে নেয়নি। আর তাই মাঝে এক বছর বিরতি দিয়ে ২০১৯ সালের পর ২০২১ সালটি ডেঙ্গুর জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে যাচ্ছে। অন্তত তথ্য উপাত্ত সেই কথাই বলছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্ষাপূর্ব মশার জরিপে রাজধানী ঢাকার চারটি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়। জরিপের তথ্যমতে, নির্মাণাধীন ভবনের জমে থাকা পানি, প্লাস্টিকের ড্রাম, বালতি, পানির ট্যাংক, বাড়ি করার জন্য নির্মিত গর্ত, টব, বোতল ও লিফটের গর্তে এডিসের লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোড, লালমাটিয়া, সায়দাবাদ এবং উত্তর যাত্রাবাড়ী এলাকায় এডিসের লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে। তবে জরিপ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু চারটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার ওপর নির্ভর করা যাবে না। অন্যান্য এলাকায়ও ডেঙ্গুর আশঙ্কা রয়েছে।

জরিপ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, জুন মাসে ঢাকার বিভিন্ন ওয়ার্ড ও দেশের বিভিন্ন স্থানে এডিস মশা নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, সারাদেশ ও রাজধানীর প্রতিটি ওয়ার্ডে এডিস মশার ঘনত্ব বেশি ছিল। গবেষণার তথ্য ও রোগীর সংখ্যা বাড়ার প্রবণতা দেখে আমরা আগেই সতর্ক করেছিলাম যে, ডেঙ্গুর বিস্তার এবার বাড়বে। এখন পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে জুলাই মাস তো বটেই আগস্টেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়বে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জরুরি পদক্ষেপ না নিলে সেপ্টেম্বর মাসও ভয়াবহ হতে পারে।

বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০০ সালে সর্বপ্রথম ডেঙ্গু জ¦র দেখা দেয়। ওই বছর ডেঙ্গুতে ৯৩ জন মারা যান। এরপর মৃত্যুর সংখ্যা ধীরে ধীরে প্রায় শূন্যে নেমে আসে। ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ তুলনামূলক কম ছিল। ওই ৮ বছরে কখনোই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ছাড়ায়নি। ২০১৫ সাল থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ আবার বাড়তে থাকে। ২০১৭ সালে কিছুটা কমে ২০১৮ সালে আবার বেড়ে যায়। ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারি পর্যায়ে পৌঁছায়। ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন রোগী শনাক্ত হয়। তবে দেশের সব হাসপাতালে ভর্তির তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে না আসায় প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশিই হওয়ার কথা। ওই বছর মৃত্যু হয় ১৫৬ জনের। তবে আইইডিসিআরের কাছে ডেঙ্গু সন্দেহে ২৬৬টি মৃত্যুর তথ্য পাঠানো হয়।

গত বছর ডেঙ্গুর বিস্তার অনেকটাই কম ছিল। ওই বছর ১ হাজার ৪০৫ জন রোগী শনাক্ত হয়। মৃত্যু হয় ৭ জনের। তবে আইইডিসিআরের কাছে ডেঙ্গু সন্দেহে ১২টি মৃত্যুর তথ্য পাঠানো হয়। মাসভিত্তিক হিসাবে জানুয়ারিতে ১৯৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ জন, মার্চে ২৭ জন, এপ্রিলে ২৫ জন, মে মাসে ১০ জন, জুনে ২০ জন, জুলাইয়ে ২৩ জন, আগস্টে ৬৮ জন আক্রান্ত হয়। আর আগস্ট মাসে ১ জনের মৃত্যু হয় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে। সেপ্টেম্বরে ৪৭ জন আক্রান্ত, অক্টোবরে ১৬৪ জন আক্রান্ত ও ৩ জনের মৃত্যু, নভেম্বরে ৫৪৬ জন আক্রান্ত ও ৩ জনের মৃত্যু হয়। আর ডিসেম্বরে ২৩১ জন রোগী শনাক্ত হয়।

চলতি বছর ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ডেঙ্গু। চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয় ২ হাজার ৯৮ জন। এখন পর্যন্ত রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) কাছে ডেঙ্গু সন্দেহে ৪টি মৃত্যুর তথ্য পাঠানো হয়। মৃত্যুগুলো ডেঙ্গুতে হয়েছে কিনা? তা নিশ্চিতে পর্যালোচনা করছে আইইডিসিআর। মাসভিত্তিক হিসাবে জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৯ জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে মাসে ৪৩ জন, জুনে ২৭২ জন এবং চলতি জুলাই মাসে (২৮ জুলাই পর্যন্ত) ১ হাজার ৭২৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে।

এডিসের বংশবিস্তার বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে ড. কবিরুল বাশার বলেন, জুলাই মাস পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টিপাত এবং উপযুক্ত তাপমাত্রায় দেশের বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা পাত্রগুলোতে এডিস মশা জন্মানোর পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবং প্রচুর এডিস মশার জন্ম হচ্ছে। পরিস্থিতি এখন এমন যে, কাউকে দোষারোপ করে সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। এখন প্রয়োজন দুই সিটির একসঙ্গে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামা। কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১০টি ব্লকে ভাগ করে পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করা। অন্যথায় করোনার এই সময় ডেঙ্গু পরিস্থিতিও ভয়াবহ হবে।

ডেঙ্গুতে আর্থিক ক্ষতির গবেষণা হয়েছিল ২০১৯ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর কারণে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে আক্রান্তদের চিকিৎসা, রোগীদের সঙ্গে হাসপাতালে অবস্থানকারীদের জন্য খরচ ও তাদের কর্মঘণ্টার হিসাব করা হয়েছে। তবে যারা হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে গেছেন তাদের খরচ এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

এদিকে মশক নিধনে বছরজুড়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম খুব একটা দৃশ্যমান হয়নি। তবে বিভিন্ন সময় বাড়ির আশপাশ ও ছাদ, বারান্দা ও আঙিনার টবের পানি বা ঘরের যে কোনো স্থানে জমে থাকা পানি একদিনের বেশি না রাখার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মেয়র। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। কিন্তু তাতেও খুব একটা সুফল আসেনি। সম্প্রতি এক বৈঠকে মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশনের কাজে উষ্মা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, মৌসুম ছাড়া এখন অন্য সময়েও মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। ডেঙ্গু এখন ‘ওয়ান টাইম ইস্যু’ নয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের প্রধান কাজ হলো, মশার উৎস নির্মূল করা। এই কাজটি স্থানীয় সরকার বিভাগের। তারা তাদের কাজ সঠিকভাবে করলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। সেজন্য বছরব্যাপী নির্ধারিত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে।

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, এ বছর ডেঙ্গুতে রোগীর সংখ্যা বাড়লেও মৃতের সংখ্যা বেশি বাড়বে না। এর কারণ হিসেবে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, ডেঙ্গুর চার ধরনের সেরোটাইপ (ডিইএনভি-১, ডিইএনভি-২, ডিইএনভি-৩ এবং ডিইএনভি-৪) রয়েছে। এ বছর ডিইএনভি-৩ আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এর বিরুদ্ধে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে গেছে। ফলে মানুষ আক্রান্ত হলেও মৃত্যু কম হবে।

তিনি বলেন, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বিস্তার ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামাঞ্চলেও। কারণ এডিস মশা স্বচ্ছ পানিতে বংশ বিস্তার করে। নালা-নর্দমা- ড্রেনগুলো ভরাট হয়ে, পাকা রাস্তা ও নগরের সুবিধা গ্রামাঞ্চলেও পৌঁছে গেছে। ফলে এডিসের বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। তবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর-এই ৪ মাস মূল মৌসুম। কয়েক দিনের থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টি এডিস মশার বংশবিস্তারে প্রভাব ফেলছে। এডিস মশার ডিম বৃষ্টির পরপরই ফুটে লার্ভা বের হয়। লার্ভা ১০ দিনের জীবনচক্র শেষ করবে। এক্ষেত্রে বৃষ্টির পর একই জায়গায় ১০ দিন পানি জমাট থাকলে সেখান থেকে এডিস মশার জন্ম হবে, যদি সেখানে আগে থেকে এডিস মশার ডিম থাকে। একটি স্ত্রী মশা কমপক্ষে একশটি ডিম দিতে পারে। ডিমগুলো যে কোনো পরিবেশে বেঁচে থাকার ক্ষমতা রাখে এবং আট মাসেরও বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারে; এমনকি কঠিন শীতের মধ্যেও। তাই সারা বছর ধরেই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জোর কার্যক্রম চলমান রাখার সুপারিশ করেন তারা।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.