
আগুনের ঝুঁকিতে সারাদেশের দুই সহস্রাধিক শিল্প কারখানার লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারী। এরমধ্যে রয়েছে প্রসাধনী সামগ্রী, কেমিক্যাল কারখানা, বিস্কুট জুস, ফুড কারখানা, ইলেকট্রনিক্স, টেক্সটাইল মিল, পাট মিল, পাট ও ঝুটের গুদামসহ নানা ধরনের শিল্পকলকারখানা। কিছু কিছু পোশাক কারখানাও রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। অগ্নিঝুঁকি ও নিরাপত্তাহীনতায় থাকা দুই সহস্রাধিক কারখানার মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভার এলাকায় বেশি। এসব শিল্পকলকারখানায় পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা নেই। পর্যাপ্ত সিঁড়ি বা বের হওয়ার প্রশস্ত পথ নেই। অনেক প্রতিষ্ঠানের নেই পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র। এসব শিল্পকলকারখানা নিয়মিত পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ করার কথা থাকলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত দফতরগুলো যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না-এমন অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের নানা শর্তে অবশ্য দেশের অধিকাংশ পোশাক কারখানা ঝুঁকিমুক্ত করতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রæপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড এ্যান্ড বেভারেজের ফুডস ফ্যাক্টরিতে সেজান জুসের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। এখন থেকে কলকারখানাগুলো নিয়মিত পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তালিকা তৈরি করা হবে ঝুঁকিপূর্ণ কলকারখানার।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের পরিদর্শকদের কাছে শুধুমাত্র পোশাক শিল্পের ৩ হাজার ৪৯৮টি কারখানার তালিকা রয়েছে। এইসব শিল্পে ২১ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক কর্মচারী কাজ করেন। তাদের পরিদর্শন তালিকার মধ্যে ২১টি কারখানার শ্রমিকের সংখ্যা জানতে পারেননি তাঁরা। আর বন্ধ পান নয়টি কারখানা। পোশাক শিল্প কারখানার বাইরে আরও দুই হাজারের বেশি শিল্পকলকারখানা আছে, যার সঠিক পরিসংখ্যান তাদের কাছে নেই। সব মিলিয়ে ৫ হাজারের বেশি শিল্প কারখানায় প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত। এর মধ্যে ২ হাজার শিল্প কলকারখানার লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারী অগ্নিনির্বাপণ ঝুঁকিসহ নানা ধরনের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ঝুঁকিতে আছে অন্তত দুই সহস্রাধিক শিল্প কলকারখানা। সেখানে নেই কোন ধরনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, নেই পর্যাপ্ত সিঁড়ি। যে কোন সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। ওইসব কারখানাতে নেই কোন নজরদারি। তবে দেশের কোথাও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। একের পর এক গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। হৈচৈ চলে কয়েক সপ্তাহ। এরপর থেমে যায় সবকিছু। কারখানার অনেক মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। যেসব কারখানায় অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই সেগুলোর তালিকা করা হয়েছে। কারখানাগুলো মনিটরিং করা হচ্ছে। কোন ধরনের ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই। এই নিয়ে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, রাজউক ও সিটি কর্পোরেশন কাজ করছে।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। প্রাণহানির পাশাপাশি হাজার হাজার টাকার সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছে ২০১০ সালে। ওই বছর আশুলিয়ার হামীম গ্রæপের একটি কারখানায় আগুনে মারা যায় ২৯ শ্রমিক। ২০১২ সালে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজনীন ফ্যাশনে ১১২ শ্রমিক ও আশুলিয়া গরিব এ্যান্ড গরিব নামে অপর একটি কারখানায় ২১ জন মারা যান। ২০১৩ সালে গাজীপুরের স্মার্ট কারখানায় ৭ জন, ২০১৬ সালে টঙ্গীতে ট্যাম্পকো ফয়লেস নামক কারখানায় ৩৫ শ্রমিক প্রাণ হারান। তাছাড়া ২০১৫ সালে সারাদেশে ১৭ হাজার ৪৮৮টি, ২০১৬ সালে ১৬ হাজার ৮৫৮টি, ২০১৭ সালে ১৮ হাজার ১০৫টি, ২০১৮ সালে ১৯ হাজার ৬৪২টি, ২০১৯ সালে ২৪ হাজার ৭৪টি, ২০২০ সালে ২১ হাজার ৭৩টি ও ২০২১ সালে জুন পর্যন্ত ৭ হাজারের মতো অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এত ঘটনার পরও সংশ্লিষ্টদের টনক নড়ছে না। নানা অব্যবস্থাপনার মধ্যেই চলছে সারাদেশে কলকারখানাগুলোর কার্যক্রম। বেশিরভাগ কারখানাতেই নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা। অনেকে রাজনৈতিক দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যান।
Leave a Reply