শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয় শিশুদের সঙ্গে

টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র

স্থানীয় চেরাগ আলী কলেজগেটের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ১৬ বছরের এক বন্দী শিশু হত্যাকাণ্ডে আরেক ১৪ বছরের শিশুর বিরুদ্ধে দায়ের করা হত্যা মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে অভিযুক্ত শিশুবন্দী। আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দীতে অভিযুক্ত শিশুবন্দী আলিফ হোসেন রিফাত (১৪) বলেছে, নানা কথা কাটাকাটি ও ঝগড়াঝাটির একপর্যায়ে শিহাবকে (১৬) পেটে ঘুষি মারে সে। হাসপাতালে নেয়া হলে শিহাবের মৃত্যু হয়। শনিবার রাতে টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে শিশু শিহাবের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত রিফাতের অভিভাবকরা বলছেন, নিবাসীর কর্মকর্তা স্টাফ কর্মচারীদের ডরভয় দেখানোর কারণে রিফাত তার নিজের ওপর হত্যাকাণ্ডের দায়ভার নিয়ে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছে। সোমবার গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের টঙ্গী জোনের উপপুলিশ কমিশনার ইলতুৎমিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জনকণ্ঠকে তিনি জানান, শিশু শিহাব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কেন্দ্রের তত্ত¡াবধায়ক এহিয়াতুজ্জামান শিশু রিফাতের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়েরের পর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠায়। আদালত শিশু আইনে তাকে আবারও টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রর বন্দীশালায় প্রেরণ করে। নিহত শিহাবের পিতার নাম ফারুক মিয়া। দেশের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থানার ভূঁইয়াপাড়া গ্রামে। টঙ্গী থানার ওসি জাবেদ মাসুদ জনকণ্ঠকে জানান, শিহাব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শুরু হয়েছে। এদিকে এই শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রতিবছরই কোননা কোন বন্দীশিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় বন্দী শিশুদের অভিভাবকরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। শিহাব হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের বন্দী সন্তানদের দেখতে আসা গেটের সামনে অবস্থান করা কয়েক শিশুর অভিভাবক জনকণ্ঠকে জানান, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রটি এখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। নানা ছলছুঁতায় এখানে মারপিটের ঘটনায় বহু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বিগত কয়েক বছরে। বন্দী শিশুদের মধ্যে মারামারি, স্টাফ কর্মচারীদের শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ এবং মারধরের ঘটনায় বহু শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। কি কারণে এবার আবারও তরতাজা এক শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো তা প্রশাসনের কেউ বলতে পারছেন না। কেউ এগিয়েও আসছে না হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটনে! শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে যা বলা এবং বলানো হয় শুধু তা-ই বাইরে প্রকাশ হয়। শিশু নিবাসের ভেতরের কোন অঘটনের কথা খুবই গোপনীয়তার মধ্যে রাখা হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, এ হত্যাকাণ্ড ঘটনার কয়েক মাস আগেও ভারতের এক শিশুকে মেরে ফেলে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের স্টাফ কর্মচারীরা। এখানে প্রতিবছরই দু’একজন করে শিশু নিবাসী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে আসছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়ায় বার বার শিশুহত্যার ঘটনা ঘটছে এই শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে। শিশুদের কয়েক অভিভাবক অভিযোগ করে জনকণ্ঠকে বলেছেন, তাদের শিশুসন্তানদের সঙ্গে নিবাসীর স্টাফ কর্মচারীরা নিষ্ঠুর আচরণ করে থাকে। চাহিদা অনুযায়ী শিশুদের খানাদানা দেয়া হয় না, কথায় কথায় মারপিট করা নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রহস্যজনক শিহাব হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে নিবাসী কেন্দ্রে ও এর আশপাশ এলাকায়। অনেকে বলছেন, ১৪ বছরের এক কিশোর কি করে পিটিয়ে আরেক কিশোরকে মেরে ফেলতে পারে? তাও আবার কয়েক শ’ নিবাসীর সামনে? হত্যার ঘটনাটি খুবই রহস্যজনক বলছেন ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা মানুষজন। উল্লেখ্য, শনিবার রাতে টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে শিহাব হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থানার ৭ নম্বর মামলার শিশু আসামি হিসাবে গত মে মাসের ৫ তারিখ থেকে পেনাল কোডের ৪৫৭/৩৮০ ধারার আসামি হিসেবে শিহাব টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে কারাভোগ করছিল। ১৪ বছরের এক শিশুর ঘুষির আঘাতে ১৬ বছর বয়সের শিশুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি কেউই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। টঙ্গীর এই শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আগে-পরের শিশু হত্যাকাÐের ঘটনায় শিশু রিফাত ও মৃত শিহাবের অভিভাবকরা এবার শিহাব হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন।

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বারবার কেন অঘটন ॥ স্টাফ রিপোর্টার যশোর অফিস থেকে জানান, যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাওয়া ৩ শিশু এখনও উদ্ধার হয়নি। পুলিশ জানায়, তাদের উদ্ধার করতে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। অন্যদিকে সবার প্রশ্ন, বারবার কেন যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে অঘটন ঘটছে? কেউ কেউ বলছে, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের নানা অনিয়মের কারণেই সেখানে থাকা শিশুরা বিক্ষোভসহ নানা ধরনের প্রতিবাদ করছে। এগুলো অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলছেন কেউ কেউ।

কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে খাবার ও ওষুধ কম দেয়াসহ নানা অনিয়মের প্রতিবাদে যশোরে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক) প্রায় তিন ঘণ্টা তাণ্ডব চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করেছে বন্দীরা। শনিবার রাত ১০ টা থেকে প্রায় একটা পর্যন্ত তারা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে ভেতরে খাট-জানালাসহ আসবাবপত্র ভাংচুর করেছে। এসময় সিঁড়িঘরের দরজা ভেঙ্গে ছাদে ওঠে বিভিন্ন অপরাধে কেন্দ্রে আসা তিন শিশু পালিয়ে গেছে। প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে রাত ১টার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়। এ ঘটনায় রবিবার যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী সায়েমুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বন্দী শিশুদের খাবার কম দেন। এছাড়া তাদের সাথে খারাপ আচারণও করা হয়। কেন্দ্রের বন্দী রাকিব, সাব্বির ও শাকিবসহ কয়েক বন্দী কিশোর জানিয়েছে, কেন্দ্রের ভেতরে তাদের তিন বেলা পেটভরে খাবার দেয়া হয় না। তাছাড়া বন্দী কিশোরদের পরিবার থেকে লোকজন এসে তাদের জন্য টাকা দিয়ে গেলে সেই টাকাও তাদের দেয়া হয় না। ওই কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের পোষ্য বন্দীদের দিয়ে সাধারণ বন্দীদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন চালানো হয়। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করলে তাদেরও মারপিট করা হয়। ফলে তারই জের ধরে বিক্ষুব্ধ বন্দী কিশোররা শনিবার রাত ১০টা থেকে এমন তাণ্ডব শুরু করে।

সূত্র মতে, ৫ মাস আগে টঙ্গী থেকে রাধা নামে এক বন্দী কিশোরকে যশোর কেন্দ্রে আনা হয়। রাধা আসার পর থেকেই ভেতরে লবিং-গ্রæপিং শুরু করে। রাধা জোড়া হত্যা মামলার আসামি। যদিও তার বয়স পূর্ণ হয়ে গেছে কিন্তু আইনের ফাঁক দিয়ে কিশোর হিসেবে সে এখানে আসে। তার নেতৃত্বে সেখানে ভাংচুর করা হয়।

যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মোঃ সায়েমুজ্জামান বলেন, করোনাকালে কেন্দ্রের বন্দীদের বাইরে বের হতে দেয়া হয় না। এজন্য তাদের ক্ষোভ আছে। খাবারের মান নিয়ে অভিযোগ আছে। এছাড়া সুপেয় পানির সমস্যা আছে।

খাবার কম দেয়া হয়- এই অভিযোগ অস্বীকার করে কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন বলেন, বেশকিছু ধরে বন্দীরা দৈনিক জনপ্রতি ৭২ টাকা করে খাদ্যের জন্য বরাদ্দের দাবি তুলে আসছিল। তাছাড়া কেন্দ্রটিতে আলাদা আলাদা রুমে সিনিয়র-জুনিয়র ভেদে খাদ্য সরবরাহের ও সুযোগ-সুবিধার দাবি তুলেছিল। সরকারী বরাদ্দের সবটুকু দিয়ে তাদের খাবার দেয়া হয়।

যদিও শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের একটি সূত্র জানিয়েছে, মাসখানেক ধরে কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক জাকির হোসেনসহ কর্মকর্তাদের ও শিশুদের একটি অংশ পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে। কেন্দ্রের দুইটি ডরমেটরি ও প্রত্যেক কক্ষের সিনিয়র শিশুকে নেতৃত্ব পর্যায়ে বিবেচনা করা হতো। এতে সিনিয়রদের কারণে জুনিয়র সদস্যরা খাবারসহ বিভিন্ন বিষয়ে বৈষম্যের শিকার হতো। মাসখানেক আগে সেই প্রথা ভেঙ্গে দিয়েছেন সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন। এতেই সিনিয়র শিশুরা তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়। বন্দী শিশুরা এডির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ করেছে। কম মানের খাবার দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের। কেন্দ্রে থাকা এক শিশুর অভিভাবক অভিযোগ করেন, তারা বাড়ি থেকে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠালেও তা শিশুদের সব দেয়া হয় না। সেখান থেকে কিছু টাকা কর্মচারীরা কেটে নেন। এতে তার সন্তান টাকা দিয়ে সব কিছু কিনে খেতে পারে না।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে এডি জাকির হোসেন বলেন, অনেক আগে থেকে কেন্দ্রে সিনিয়র-জুনিয়র রেয়াজ ছিল। প্রত্যেক কক্ষের সিনিয়রদের মাধ্যমে যে কোন সমস্যার সমাধান করা হতো। এতে ওই সিনিয়র শিশুরা বিশেষ সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করত। জুনিয়ররা তাদের ভয়ে থাকত। সিনিয়রদের বিরুদ্ধে নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন ও বিক্রি, জোর করে ছোটদের সমকামীতায় লিপ্ত করানো এবং বেশি পরিমাণ খাদ্য নেয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ শোনা যেন। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে মাসখানেক আগে সিনিয়র-জুনিয়র রেয়াজ তুলে দেয়া হয়। যে কোন সমস্যার সমাধান কর্মকর্তারাই করেন। সিনিয়র শিশুদের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান না করায় তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সেই ক্ষোভ থেকেই তারা তাÐব চালায়। তারা সিনিয়র-জুনিয়র প্রথা চালু রাখতে চায়। কিন্তু বৈষম্য বিলোপের জন্যে সেটা সম্ভব নয়।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.