
মারিয়া আক্তার মুন্নী, সবেমাত্র ১৫ তে পা দেয়া এক দুড়ন্ত কিশোরী। অষ্ঠম শ্রেনীতে পড়াশোনা করছিলেন। করোনার কারনে স্কুল বন্ধ থাকায় অভাবের সংসারে কিছু বাড়তি কিছু উপার্জনের আশায় যোগ দিয়েছিলেন হাসেম ফুডের আগুন লাগা বিল্ডিংয়ে। ঘটনার দিন তার ডিউটি ছিল দোতলার টোষ্টার সেকশনে। বিকেল ৫ টা ডিউটি শেষ হয়ে হলেও সেকশন ইনচার্জ তাকেসহ সে সেকশনের অন্যান্যদের বলেন, টার্গেটে কাজ করতে হবে। রাত ৮ টার আগে ছুটি নেই। আবার মালামাল প্যাকেটিং এ মনোনিবেশ করেন মুন্নী।
সন্ধ্যা পৌণে ৬টার দিকে কি হয়েছে বোঝার আগেই দেখেন চারিদিকে হুড়োহুড়ি, দৌড়াদৌড়ি। আতংকে দৌড়াতে গিয়ে কেউ পরে যাচ্ছেন মেঝেতে।
কেউ বা আশ্রয় নিয়েছেন স্তুপ করা মালের পিছনে। সেখানে কাজ করা প্রায় ৬০ জন শ্রমিকের বড় একটি অংশ সিড়ি দিয়ে নীচে নামতে গিয়ে ধোয়া দেখে আবার ফিরে আসেন দোতলায়। এসময় আস্তে আস্তে ধোয়া গ্রাস করতে থাকে দোতলার ফ্লোর। বন্ধ হয়ে যায় ফ্লোরের লাইট, ফ্যান। মেশিনগুলোও থেকে যায় একে একে। শুধু মানুষের আর্তনাদ। শত মানুষ একসাথেই আর্তনাদ কলিজায় কাপুনি ধরিয়ে দেয় মুন্নীর। কিছুক্ষণ ভয় পাওয়া কবুতরের মতো কাঁপতে কাপঁতে ফ্লোরের একটি টেবিলের ভিতরে গিয়ে আশ্রয় নেয় সে। দোতলার ভেতরে আগুনের তাপদহ আর ধোয়াচ্ছন্ন দমবন্ধ পরিবেশে তখন শোনা যাচ্ছিলো ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার। ‘আল্লাহ আল্লাহ, মাগো, বাবাগো’ বলে কান্না করছিলেন সবাই। আগুণের লেলিহান শিখা যেনো নীচ থেকে সিড়ি দিয়ে উকি মেরে বারবার দেখিয়ে যাচ্ছিলো তার ভয়ংকর রুপ। সন্ধ্যা তখন সোয়া ৭ টা। বাইরে শোনা যাচ্ছিলো এ্যাম্বুলেন্স আর ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির সাইরেন। সে শব্দ ছাপিয়েও আসছিল বাইরের লোকের চিৎকার চেঁচামিচির শব্দ। একসময় ফ্লোরের কিছু সাহসী যুবক দক্ষিন দিকের সাটার ভাঙ্গতে শুরু করেন। হাতের কাছে যে যা পেয়েছে প্রাণ রক্ষার আশায় সাটারে আঘাতের পর আঘাত করে যাচ্ছে। একসময় পরাস্ত হয়ে ভেঙ্গে যায় সাটার। লোকজন লাফিয়ে লাফিয়ে নীচে পড়তে থাকে। মুন্নীও তখন টেবিলের নীচ থেকে বের হয় ভাঙ্গা সাটারের কাছে এসে দেখতে পান কাছেই রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের অধিক উচ্চতায় অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধারকাজে ব্যবহারিত স্নোরকেল ল্যাডার কিংবা হাই টার্ন্টেবল ল্যাডার জাতীয় বিশেষ মই। সে লাফিয়ে পড়েন সেখানে। সেখানে পড়ে চোখের ডানপাশ লোহার সাথে আঘাতে মারত্মকভাবে জখম হয় মুন্নী। সে সময় মই দেখে ৫ অথবা ৬ তলা থেকে লাফ দেয় এক যুবক। সে মইতে না পড়ে পড়ে নীচে।
মুন্নীর দেখামতে সেখানেই না কি প্রাণ হারায় সে শ্রমিক। এভাবেই সেদিন হাসেম ফুডস এন্ড বেভারেজ কারখানায় কাজ করতে গিয়ে প্রাণে বেচেঁ যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিক মারিয়া আক্তার মুন্নী ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। বর্ণনা দিতে গিয়ে তার শরিরে কাপুনী উঠে। এসময় তার মা হাজেরা আক্তার জানান, মুন্নীকে প্রথমে এ্যাম্বুলেন্সে করে স্থানীয় ইউএস বাংলা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলেও তারা সেখানে চোখের চিকিৎসা দিতে না পারায় মুন্নীকে সেখান থেকে বাসায় নিয়ে আসেন। তখন মুন্নী ভয়ে কাপছিলো শুধু। বাসাতেই চিকিৎসক এনে তার চিকিৎসা করানো হচ্ছে। তবে গতকাল থেকে মুন্নী চোখে ঘোলা দেখছেন। তাকে উন্নত চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছেন স্থানীয় চিকিৎসক। এ কারণে আহতের তালিকায় নাম অন্তভুক্ত করতে ছুটে এসেছেন কারখানার গেইটে। কিন্ত অনেকের হাতে পায়ে ধরেও কোন কাজ হয় নি। তাদের আরেক আতংক তার মেয়ে কারখানার শ্রমিক এটা প্রমানের আইডি কার্ড রয়ে গেছে কারখানার ভেতরেই।
হাজেরা বেগম আরো জানান, একসময় চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার শ্যামপুরে তাদের বাড়ি ছিল। কিন্ত অভাবের তাড়নায় সেটা বিক্রি করে চলে আসেন ঢাকায়। তার কোন ছেলে নেই। তিন কন্যা সন্তানের মাঝে মুন্নী মেঝো। পড়াশোনা করতেন স্থানীয় মজিবর রহমান ভূইয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। মুন্নীর বাবা মনির হোসেন গোলাকান্দাইল নাগেরবাগ জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন। বেতন পান ৫ হাজার টাকা। এ কারনে তার বড় মেয়ে উম্মে আয়েমা একটি পোশাক কারখানায় কাজ করে। তাদের দুজনের উপার্জনে চলতো মুন্নী আর তার ছোট বোন উম্মে সায়েমা হোসাইফার পড়াশোনা ও সংসারের খরচ। বাড়ি ভাড়া দিতে পারেন না বলে গোলাকান্দাইল বেরীবাধে একটি ছাপড়া তুলে বসবাস করেন এই পাচজন। এখন যদি আহতের তালিকায় নাম না তুলতে পারেন কিংবা সরকারি কোন অনুদান না পান তার চোখটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিভাবে চলবে তার মেয়ের চিকিৎসা। সে চিন্তা কুরে খাচ্ছে হাজেরা বেগমকে।
Leave a Reply