ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা

রোহিঙ্গাদের ফাইল ছবি

মিয়ানমার থেকে আসা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের টেকনাফ ক্যাম্পে বসবাস করছেন। যদিও তারা এখন ঠিক ক্যাম্পের মাঝে আবদ্ধ নন। শস্তা শ্রম ও নকল কার্ডের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছেন যতটুকু সম্ভব।

স্থানীয় সিএনজিচালক সৈয়দ আলম বলেন, ‘কী শান্ত ছিল শহরটা! রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে যত বিপত্তি। কেউ আল-ইয়াকিন, কেউ সালমান শাহ গ্রুপের সদস্য। চাঁদাবাজি, অপহরণের ঘটনা ঘটছে অহরহ। চার-পাঁচ লাখ টাকার জন্য অপহরণ করা হয়। সর্বত্রই আজ রোহিঙ্গাদের বিচরণ, ভুয়া কার্ড তো আছেই।’

তিনি বলেন, ‘১১ বছর সিএনজি চালাই। এ পথের যাত্রী কারা তা আমরা জানি। রোহিঙ্গাদের শনাক্তে সরকার কার্ড করেছে কিন্তু ভুয়া কার্ড দেখার তো কেউ নেই। ভুয়া কার্ডে ওদের ঠাটবাট (জাঁকজমক) চলাফেরা! সিএনজির ৭০ শতাংশ যাত্রীই এখন রোহিঙ্গা। ওরা টেকনাফ, উখিয়া থেকে ওঠে। কক্সবাজারেও আসে। পথে চেকপোস্টে আটকায়, কার্ড দেখালেই ছেড়ে দেয়। কিন্তু সে কার্ড আসল না নকল, তা খতিয়ে দেখার কেউ নেই, নেই কোনো পদ্ধতিও।’

আজিজুল শেখ নামের একজন রোহিঙ্গা বলেন, ‘এখানকার রোহিঙ্গাদের অনেকে অটোরিকশা আর সিএনজিরচালক। কেউ আবার জেলে; মাছ ধরে, বেচা-কেনাও করে। কিন্তু এটা করার সুযোগ তাদের নেই। কী করবে তারা? মানুষ তো, ঘরে বসে কতক্ষণ থাকা যায়! চাহিদার প্রয়োজনে বাইরে বের হয়। এখন তাদের (রোহিঙ্গা) বিচরণ ক্যাম্পের বাইরেও।’ রোহিঙ্গা কিশোর ফয়সাল আহমেদ (১৫)। থাকে মুসুনি ক্যাম্পে। একটি হোটেলে কাজ করে সাত মাস হলো। মাসে বেতন পাঁচ হাজার টাকা। কথা বলতে বলতে থমকে যায় ফয়সাল, আছে জড়তা।

মোহাম্মদ ফয়সাল বলে, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এখন খারাপ মানুষ থাকে। সেখানে অনেক সমস্যা। মারামারি-কাটাকাটি তো আছেই। আমার পরিবার পুরোনো রোহিঙ্গা। বাংলাদেশেই আমার জন্ম। বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। আমরা দুই ভাই, এক বোন, সঙ্গে মা আছেন। দুই ভাই একটি মাদরাসায় ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু পরিবারের হাল ধরতে আমাকে হোটেলে কাজ করতে হচ্ছে।’

ফয়সাল বলে, ‘মুসুনি ক্যাম্পেই (রোহিঙ্গা ক্যাম্প) থাকতে পারতাম। কিন্তু থাকি না, নির্যাতন করে। মারামারি, অপহরণ সেখানকার নিত্যদিনের ঘটনা। কখনো সালমান শাহ গ্রুপ, কখনো আল-ইয়াকিনের সদস্যরা নির্যাতন করে। অপহরণেরও শিকার হতে হয়।’ নয়াপাড়া ১নং ক্যাম্পের সামনেই কথা হয় টেকনাফের বাসিন্দা (বাংলাদেশি) ইউনুস আলীর সঙ্গে। দোতলা বাড়ির নির্মাণকাজ চলছে তার। শ্রমিকের খোঁজে নয়াপাড়ায় এসেছেন। ইউনুস আলী বলেন, ‘দেশীয় শ্রমিক দিয়ে কাজ করালে দিনে ৪০০-৫০০ টাকা দিতে হয়। কিন্তু ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকায় পাওয়া যায় রোহিঙ্গা শ্রমিক। এছাড়া ওরা বেশ পরিশ্রমী। এ সুযোগটা নিচ্ছেন অধিকাংশ স্থানীয়রা। কিছুই করার নেই।’

টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুলতান আহমেদ নয়াপাড়া ১নং ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকায় বসবাস করেন। রোহিঙ্গাদের অবাধ বিচরণে উদ্বেগ, একইসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘তাদের কারণে (রোহিঙ্গা) স্থানীয়রাই এখন বিপাকে। ওরা যখন প্রথম আসে, মানবেতর জীবনযাপন শুরু করে তখন আমরাই (স্থানীয়রা) এগিয়ে আসি, সাহায্য-সহযোগিতা করি। যদিও আমরা ভবিষ্যতের শঙ্কায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। তাদের (রোহিঙ্গা) তো ক্যাম্পের বাইরে আসার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ঠিকই তারা বাইরে বের হচ্ছে, নানা কাজে জড়িয়ে পড়ছে। আজ আমরা রোহিঙ্গাদের কারণে বড় বিপদে আছি। পথে-ঘাটে, দোকানে-বাজারে, গাড়িতে সর্বত্রই তাদের দেখা মেলে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আজ ঘরে ঘরে রোহিঙ্গা। তারা আমাদের স্থানীয় যুবসমাজকে ধ্বংস করছে। কাউকে ইয়াবা দিয়ে, কাউকে নারী দিয়ে। রোহিঙ্গারা আর ফিরবে না, এটা এক রকম স্পষ্ট। শান্ত টেকনাফ আজ অশান্ত-বিশৃঙ্খল হয়েছে রোহিঙ্গাদের কারণে। শৃঙ্খলা ফেরানোর কোনো উদ্যোগ নেই স্থানীয় প্রশাসনের।’

সুলতান আহমেদের দাবি, ‘এক কার্ড দিয়ে অর্ধশতাধিক নকল কার্ড তৈরি করছে রোহিঙ্গারা। সেই কার্ড দিয়ে তারা নির্বিঘ্নে ঘুরছে। কিন্তু স্থানীয় হলেও আমাদের সবখানে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। সস্তা শ্রম দিয়ে শুধু টেকনাফ নয়, পুরো কক্সবাজারের শ্রমবাজার ধরে ফেলেছে রোহিঙ্গারা। এ সুযোগও নিয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। মাসিক চার/পাঁচ হাজার টাকায় ওরা কাজ করে। যেখানে একদিনে স্থানীয়দের দিতে হয় ৫০০ টাকা। রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের কাজের পথও রুদ্ধ করা হয়েছে।’

বাংলাদেশ পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘তাদের (রোহিঙ্গা) তো ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেউ যদি বাইরে আসে, আর আমরা যদি খবর পাই তাহলে তাদের আবার ধরে ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দেব।’

অপহরণ ও মানবপাচারের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মানবপাচারের মতো ঘটনায় পুলিশ অভিযোগ পেলেই খতিয়ে দেখছে। অপহরণের ঘটনা যাচাই-সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক আল-ইয়াকিন কিংবা আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) মতো উগ্রবাদী সংগঠনের অস্তিত্ব ‘অস্বীকার’ করে তিনি আরো বলেন, ‘এ ধরনের কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। তারপরও আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.