
কাঠগড়ায় ধর্ষণের শিকার নারীকে দুশ্চরিত্রা দেখিয়ে জেরা করার সুযোগ দেড়শ বছরের বেশি সময় ধরে আইনে রয়েছে, তা সংশোধনে সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন অধিকার কর্মীরা। অবশ্য শুধু সাক্ষ্য আইনের একটি ধারার পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই ধর্ষণের সঠিক বিচার নিশ্চিত হবে না, দ্রুত ও যথাযথ বাস্তবায়নও করতে হবে বলে মত তাদের।
এছাড়া আইনের ফাঁকগুলোর সুবিধা নিয়ে দোষী ব্যক্তি যাতে ছাড় না পায় তা নিশ্চিত করাসহ ধর্ষণের শিকার নারীকে মানুষ হিসেবে প্রাপ্য সম্মান ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে যথাযথ বিচারের জন্য সরকারকে বিশেষ সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার দাবি আসে।
গত ৩০ জুন সংসদে বাজেট পাসের প্রক্রিয়ার সময় আইনমনন্ত্রী জানান, সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারায়, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির চরিত্র নিয়ে কথা বলার যে সুযোগ আছে, তা পরিবর্তন করা হবে। সেপ্টেম্বরে খসড়া আইন সংসদে তোলা হতে পারে।
এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, সাক্ষ্য আইনের এই সংশোধনের দাবিটি দীর্ঘদিনের। কিন্তু বিষয়গুলো অনেক ধীরগতিতে এগোচ্ছে। সরকার অনেক আগেই সমাধান করতে পারত। তিনি বলেন, এখন দ্রুত আইন পরিবর্তন এবং তার বাস্তবায়ন করতে হবে। রেইপ বেড়ে গেল, আমি একজনকে যাবজ্জীবন দিলাম-তা নয়। আইন কার্যকর করতে হবে।
ধর্ষণের শিকার নারীর ক্ষেত্রে ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট (যৌনাঙ্গে দুই আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে যে পরীক্ষা করা হয়) নিষিদ্ধ করে আদালত যে আদেশ নিয়েছে, তা সহ এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন তিনি।
মালেকা বেগম বলেন, ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনগুলোর একটা সামগ্রিক পর্যালোচনা করা দরকার। ডিএনএ টেস্ট করার সময় যাতে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি হেনস্তা না হয়। এইগুলো আইনের মধ্যে আনতে হবে। আইন যতই কঠোর হোক না কেন, তাতে কাজ হচ্ছে না। ফাঁক থেকে যাচ্ছে। দোষী বেরিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া বিদ্যমান আইনে ধর্ষণের যে সংজ্ঞা রয়েছে, তা পরিবর্তন করে তাতে লিঙ্গ নির্বিশেষে যৌন সহিংসতার বিভিন্ন ধরনকে অন্তর্ভুক্ত করারও দাবি জানান নারী আন্দোলনের এই নেত্রী।
সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ১৫৫ (৪) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যখন ‘বলাৎকার বা শ্লীলতাহানির চেষ্টার’ অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারী সাধারণভাবে ‘দুশ্চরিত্রা’। ওই ধারা সংশোধনের জন্যও দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন অধিকারকর্মীরা।
গতবছর নভেম্বরে আন্দোলনের মুখে ধর্ষণের সাজা বাড়িয়ে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন’ আইন সংশোধন করে সরকার। সেখানে ‘ধর্ষিতা’ শব্দটি বদলে ‘ধর্ষণের শিকার’ শব্দ দুটি বসানো হয়। কিন্তু সাক্ষ্য আইন সংশোধন করা হয়নি।
বহুকাল অপেক্ষার পর সরকার আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ায় স্বাগত জানান আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামী। তিনি বলেন, ভিকটিম ব্লেইমিংয়ের এই সুযোগটা পুলিশ, আইনজীবী ও অভিযুক্তরা নিত। দীর্ঘদিন বিষয়টা নিয়ে আন্দোলন চলছিল। আমরা আশা করি, যত তাড়াতাড়ি এটার বাস্তবায়ন হবে, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি তত তাড়াতাড়ি সুফল পাবে। ধর্ষণের সংজ্ঞার পরিবর্তন করে সেই আইন দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি করেন নীনা। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) গবেষণা বিশেষজ্ঞ তাকবীর হুদা মনে করেন, শুধু সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারা সংশোধন করলেই ধর্ষণের শিকার নারীর আদালতে ‘হেনস্তা’ হওয়া বন্ধ হবে না। তার জন্য আরো উদ্যোগ নিতে হবে। সাক্ষ্য আইনের ১৪৬ ধারা উপধারা ৩ এরও সংশোধন চান তিনি, যেখানে জেরার সময় সাক্ষীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাকবীর হুদা বলেন, সেখানে বলা আছে, সাক্ষীকে তিন ধরনের প্রশ্ন করা যাবে।
তৃতীয় উপধারায় বলা হয়েছে, সাক্ষীর চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন করা যেতে পারে, যাতে সে এমন তথ্য দেয় যা দোষী বা নির্দোষ সাব্যস্ত করতে সহায়ক হবে। ফলে ১৫৫ (৪) ধারা সরিয়ে ফেলা হলেও ১৪৬ (৩) এর মাধ্যমে চাইলে ধর্ষণ মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী একই ধরনের প্রশ্ন করতে পারেন।
সামগ্রিকভাবে রেইপ শিল্ড ল বা ধর্ষণপ্রতিরোধী একটি আইন প্রণয়নের দাবি জানান তিনি। তাকবীর বলেন, এ আইন মানে হচ্ছে, খুব স্পষ্টভাবে বিচারকদের ওপর একটা দায়িত্ব দেবে, ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে যেন কোনো কুরুচিপূর্ণ প্রশ্ন না করা হয়। সেটার একটা নিশ্চয়তা দিতে হবে।
Leave a Reply