
দেশের গ্রামাঞ্চলে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বর্ষাকালে গ্রামের মানুষ করোনা সংক্রমণকে সাধারণ সর্দি-কাশি হিসেবে মনে করায় দ্রুত পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত মারাত্মক পর্যায়ে চলে যাওয়ার আগে সাধারণ মানুষ করোনা পরীক্ষা না করানোর কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, করোনা প্রতিরোধে তিনটি প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রথমটি টিকাদান কর্মসূচী। দ্বিতীয়টি পরীক্ষা করে রোগীকে আইসোলেশনে রাখা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। আর তৃতীয়টি হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। দেশে ব্যাপক আকারে না হলেও টিকাদান কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে কঠোর বিধিনিষেধও চলছে দেশে। তবে নতুন ধরনের ডেল্টার প্রভাবে শুরুতে সীমান্ত এলাকায় হলেও এখন সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়েও সীমান্ত এলাকার সংক্রমণের ঢেউ শুরুই হয় গ্রামাঞ্চল দিয়ে। ভারতের সীমানা ঘেঁষা এলাকায় করোনার সংক্রমণ আস্তে আস্তে শহরেরও ছড়িয়ে পড়ছে। গত বছর প্রথমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণটি গ্রামাঞ্চলে কম ছড়িয়েছিল। প্রথম ঢেউটি ছিল শহরকেন্দ্রিক। অপেক্ষাকৃত গ্রাম ছিল করোনামুক্ত। এবার ঘটেছে উল্টোটা। বর্তমানে শহরের চেয়ে গ্রামের রোগী বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেছেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা সংক্রমিত রোগীদের ৫০ শতাংশের বেশি গ্রামের। এসব রোগী রোগের তীব্রতা অনেক বেশি হওয়ার পর হাসপাতালে আসছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর রবিবার ৪৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ও চিকিৎসকদের সঙ্গে দীর্ঘ তিন ঘণ্টার বেশি বৈঠক করেছে। তারা বলেছেন, রোগীর অধিকাংশের বেশি গ্রামের। রোগীরা হাসপাতালে আসছেন রোগে আক্রান্ত হওয়ার বেশ পরে, যখন পরিস্থিতি অনেক খারাপ হয়ে পড়ছে।
মহাপরিচালক আরও বলেন, এখন বর্ষার মৌসুম। অনেকেই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলেও সাধারণ সর্দি-জ্বর বা কাশিতে আক্রান্ত বলে ধরে নিচ্ছেন। পরীক্ষা করাচ্ছেন না বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন না। তিনি আরও বলেন, মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের গ্রামে গ্রামে মাইকিং করার পরামর্শ দিয়েছি। বাড়ি বাড়ি রোগীর খোঁজ রাখতে বলেছি।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা ৭০ শতাংশের বেশি রোগী এখন গ্রামের। শুরুতে শহরের করোনা রোগী বেশি ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে গ্রামাঞ্চলের রোগী গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসা নিতে আসছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালের করোনা চিকিৎসা বিষয়ক ডাঃ নাহিদুল ইসলাম মুন জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনায় চিকিৎসা নিতে আসা বেশিরভাগ মানুষই গ্রামাঞ্চলের। শুরুতে হালকা সর্দি-কাশিসহ মৃদু উপসর্গ থাকলেও তারা করোনা পরীক্ষা করেনি। আস্তে আস্তে শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে চিকিৎসা নিতে আসছেন। পরীক্ষা করাতে দেরি করায় বাড়ির অন্য সদস্যদেরও তিনি ঝুঁকিতে ফেলেছেন। এভাবে কোন কোন পরিবারের ১০০ শতাংশেরই করোনা শনাক্ত হয়েছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে গ্রামাঞ্চলে মাইকিংসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচী হাতে নেয়ায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, করোনা প্রথম ঢেউটি ছিল শহরকেন্দ্রিক। কিন্তু এবার দ্বিতীয় ঢেউয়ের বর্তমান পরিস্থিতি যেটা নতুন প্রজাতি ডেল্টার কারণে বেশি সংক্রমণ ঘটাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে সেটি হচ্ছে গ্রামকেন্দ্রিক। এটিই বড় ভয়ের কারণ। বাংলাদেশের মতো দেশে গ্রামের মানুষ খুব বেশি স্বাস্থ্য সচেতন নয়। চিকিৎসার অবকাঠামোও তেমন নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা কম ও বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে গাদাগাদি করে বসবাস করার কারণেই করোনা দ্রæত বিস্তার ঘটছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকহারে করোনা ছড়িয়ে পড়ার কারণেই পরিস্থিতি নাজুক আকার ধারণ করে। আমাদের গ্রামাঞ্চলে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে দ্রæত শনাক্ত করে চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।
আইইসিডিসারের উপদেষ্টা ডাঃ মুশতাক হোসেন বলেন, গত ঈদে মানুষের গাদাগাদি করে গ্রামে ফিরে যাওয়া এবং ডেল্টার প্রভাবে এখন সারাদেশে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা, মাস্ক না পরা এবং সামাজিক দূরত্ব না মেনে চলার মতো ঘটনাতেই সংক্রমণ বাড়ছে। এছাড়া জুন মাসে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি পালনে ঢিলেঢালা ভাব দেখা গেছে। একইসঙ্গে দোকানপাট, গণপরিবহনে গাদাগাদি করে চলাচল করতে দেখা গেছে।
তিনি আরও বলেন, সংক্রমণ রুখতে সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনের পরিধি আরও বাড়ানো হয়েছে। ১৪ জুলাই পর্যন্ত বর্তমান বিধিনিষেধ বহাল থাকবে। এটি কার্যকরভাবেই মানতে হবে। এছাড়া গ্রামাঞ্চলের মানুষকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। করোনার মৃদু উপসর্গ দেখা দিলেও পরীক্ষা করে আইসোলেশনে চলে যেতে হবে। পরিবারের বাকিদের থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। কোন উপসর্গকেই অবহেলা করা চলবে না। যত বেশি পরীক্ষা করা যাবে তত বেশি করোনাকে প্রতিহত করা যাবে। এটি গ্রামের মানুষকে বোঝাতেই হবে।
Leave a Reply