
রাজধানী ছেড়ে জেলা শহরের পর এখন প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে গ্রামাঞ্চলে। রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ ও খুলনা জেলার গ্রামাঞ্চলে করোনার বিস্তৃতি বেড়ে গেছে। অনেক উপজেলায় সর্দি-কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত রোগী আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বেশির ভাগ হাটবাজারে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত। জোর করেও তাদের মাস্ক পরানো যাচ্ছে না। জনসমাগম এড়িয়ে চলার নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়েও তেমন কাজ হচ্ছে না। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ প্রবণতাকে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন। তারা উপজেলা পর্যায়ে অক্সিজেন সরবরাহ, অক্সিজেন মাস্ক, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা সরবরাহ করাসহ চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন।
রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন কাইয়ুম তালুকদার বলেন, গ্রামের মানুষ কম সচেতন, মাস্ক পরে না। গ্রামের মানুষের মধ্যে নমুনা পরীক্ষায়ও আগ্রহ কম। একেবারে উপসর্গ দেখা দিলে তারা করোনার পরীক্ষা করায়। এ কারণে শনাক্ত ও মৃত্যুহার বেশি।
খুলনার সিভিল সার্জন নিয়াজ মোহাম্মদ জানান, উপজেলাগুলোয় রোগী বাড়ছে। পারিবারিক-সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্যবিধির বিষয়েও উদাসীনতা চোখে পড়ার মতো, এসব কারণেই গ্রামে সংক্রমণ পরিস্থিতি ঊর্ধ্বমুখী। নওগাঁর সিভিল সার্জন এ বি এম আবু হানিফ বলেন, জেলায় হঠাৎ বেড়ে গেছে সর্দি-কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। উপসর্গ থাকলেও অধিকাংশ মানুষ করোনা পরীক্ষায় তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
এ অবস্থায় করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আলোচকরা ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ মডেল’ কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
গতকাল করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অভিজ্ঞতা বিনিময় নিয়ে এক ওয়েবিনারে এই আহ্বান জানান তারা। ওয়েবিনারের আয়োজন করে দ্য হ্যাঙ্গার প্রজেক্ট।
ওয়েবিনারে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য সামিল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনার সংক্রমণ বেড়ে গেলে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে সামাজিকভাবে করোনা প্রতিরোধে কৌশল নির্ধারণ করা হয়। বিশেষ করে তরুণদের নিয়ে পাড়া-মহল্লায় ৫০০টির মতো কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এসব কমিটি শারীরিক দূরত্ব মানা ও মানুষকে বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে নিরুৎসাহিত করতে কাজ করে। ফলে করোনার সংক্রমণ দ্রুত কমতে শুরু করে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে যে ২৩ জন করোনায় আক্রান্ত রোগী মারা গেছে, তারা কেউ করোনার টিকা নেয়নি বলে ওয়েবিনারে জানান সংসদ সদস্য সামিল উদ্দিন আহমেদ। করোনার দুই ডোজ টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের মাত্র একজন ও এক ডোজ টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন আক্রান্ত হন বলে তিনি উল্লেখ করেন। করোনার সময় ১ লাখ মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেসময় শিবগঞ্জের ৭০ শতাংশ মানুষ মাস্ক ব্যবহার করায় শিবগঞ্জ উপজেলায় করোনা সংক্রণের হার দ্রুত কমে এসেছিল।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল ভারতের সীমান্তসংলগ্ন হওয়ায় বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল বলে জানান সামিল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ভারত থেকে যারা এসেছিল, তাদের কোভিড নেগেটিভের সনদ থাকলেও বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের আইসোলেশনে রাখা হয়। ১৪ দিন পর তাদের কোভিড টেস্ট নেগেটিভ হলে তবেই তারা ছাড়া পেত।
ওয়েবিনারে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ভিয়েতনাম ও আরো কয়েকটি দেশ তাদের রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে দেশের জনগোষ্ঠীকে একত্র করে করোনা মোকাবিলা করেছে এবং তারা সফল হয়েছে। কিন্তু আমেরিকা ও ইউরোপের কিছু দেশ তাদের শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরও করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ এসব দেশে আত্মকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ক্রান্তিলগ্নে আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমাদের সবাইকে একত্র করা ছাড়া বিকল্প নেই। এ জন্যই বলব, স্থানীয় সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে ইউপি সদস্য পর্যন্ত সব জনপ্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করে কাজ করতে হবে। সব মানুষের মাস্ক পরা, আইসোলেশনে থাকা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ইত্যাদি কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে।’
দুই সপ্তাহের মধ্যে কমবে আশা প্রকাশ করলেও আগামী ঈদে আবার বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরামর্শক মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, এজন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। করোনা রোগী যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই আইসোলেশন করতে হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ মডেল প্রশংসা করে এই জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, সেখানে ব্যাপকহারে মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে, আইসোলেশন করা হয়েছে। অন্য এলাকায়ও এই মডেল প্রয়োগের ওপর গুরুত্বরোপ করেন তিনি।
ওয়েবিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস করোনা রোগীর বাড়িতে লাল পতাকা টাঙানোর বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য সামিল উদ্দিন আহমেদের কাছে জানতে চান। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, লাল পতাকা টাঙানো যাবে না। এটা ভয়ের কারণ। মানুষ যাতে ভয় না পায়। রোগী ব্যবস্থাপনাকে উৎসাহব্যঞ্জক করতে হবে।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জনপ্রতিনিধিদের গঠনমূলক ও আস্থাশীল নেতৃত্বের ওপর গুরুত্ব দেন দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই যদি প্রত্যেকের সুরক্ষার জন্য কাজ করি, তাহলে আমাদের সবার সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।’
Leave a Reply