আলীকদমের উন্নয়ন প্রকল্প গিলে খাচ্ছে আ’লীগ-বিএনপির ঠিকাদারি সিন্ডিকেট

বামে আলীকদম উপজেলা আ'লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ঠিকাদার কফিল উদ্দিন, মাঝে বিএনপি নেতা আবু বক্কর ও ডানে উপজেলা আ'লীগের সহ-সভাপতি ঠিকাদার জামাল উদ্দিন। ছবিঃ সংগৃহীত

সময় মে ২০২০। করোনাভাইরাস জনিত কারনে লকডাউনের সুযোগে বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার দুর্গম কুরুকপাতা এলাকায় কুরুকপাতা মৈত্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদার উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক আলীকদম সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন। শিক্ষার্থীরা ঝুঁকিতে পড়বে ভেবে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহারের বিষয়টি বোর্ডের কর্মকর্তাদের জানায় বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক। বিভিন্ন পত্রিকায় এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মাঝে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে রডের বদলে বাঁশ ব্যবহারের সত্যতা পায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন উপসহকারী প্রকৌশলী ত্রিদিব কুমার ত্রিপুরা অভিযুক্ত ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে গণমাধ্যমকে জানান। তবে পরবর্তীতে এই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে আর কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর আগে ২০১৭ সালের জুনে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের এক ঠিকাদার বান্দরবান সরকারি মহিলা কলেজের অ্যাকাডেমিক ভবন সম্প্রসারণ কাজের প্রাচীর তৈরিতেও লোহার রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করেছিলেন।

২০২০ সালে লকডাউনের সুযোগে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) আলীকদম উপজেলায় তিন কোটি ৫৮ লাখ টাকা ব্যয়ে আলীকদম-পোয়ামুহুরী হয়ে জানালীপাড়া পর্যন্ত ৫ কিলিমিটার সড়ক মেরামতে ব্যপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। সড়ক মেরামতে খোয়ার বদলে পুরনো দেয়ালের সিমেন্ট মিশ্রিত ভাঙ্গাচোরা পরিত্যক্ত সরঞ্জাম ব্যবহার করে। যা কাজ শেষ না হতেই সড়কের অবস্থা মেরামতের আগের অবস্থা থেকেও খারাপ হয়ে যায়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরার লাইন্সেন্সে সড়ক মেরামতের কাজটি করে নোয়াপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির বর্তমান আহ্বায়ক আবু বক্কর, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কফিল উদ্দিন, উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক ১ নং আলীকদম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে আলীকদম থানা পরিষদ প্রকল্পের নামে দুই হাজার মিটার থানা পরিষদ সড়ক মেরামতের কাজটি বাস্তবায়ন করে -হোসাইন অ্যান্ড কোং ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঠিকাদার আবু বক্কর। নির্মাণের এক সপ্তাহের মধ্যে দুই দিনের বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় মেরামত করা রাস্তার কার্পেটিং। ফলে সরকারের ২৪ লাকখ টাকায় জলে যায়। আর এই কাজে ঠিকাদার আবু বক্করের অংশীদার ছিলেন জামাল উদ্দিন।

বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলীকদম উপজেলার পাহাড়ী-বাঙ্গালী জন সমাজের ঘূর্ণিয়মান অর্থনীতির চাকা এখনো ধীরলয়ে চলছে। বসবাসরত সিংহভাগ লোকজন অর্থনৈতিকভাবে সুযোগসুবিধা এখনো পায়নি। পাহাড়ী ভূমিতে জুম চাষ করে অধিকাংশ উপজাতীয় লোকজন জীবিকা নির্বাহ করেন। সেই আদিম পদ্ধতিতে জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা আহরণ করে এলাকার সবুজ পাহাড়কে শ্মশানের ছাইয়ে পরিণত করলেও অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসেনি তাদের। আর পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প পাশ হয় এই এলাকায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপির নিরলস প্রচেষ্টায় এই এলাকার উন্নয়নে যত প্রকল্পেরই কাজ হয় তা চলে যায় এসব দূুর্নীতিবাজ ঠিকাদারদের পকেটে। ফলে পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন আর হয়নি।

সম্প্রতি ২০২০-২১ অর্থবছরে আলীকদম উপজেলা গ্রামীণ রাস্তা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নয়াপাড়া ইউনিয়নে নয়াপাড়া রাস্তার থেকে মংব্রাচিং মার্মা পাড়া হয়ে শৈলকুটি দিয়া নয়াপাড়া বাজার, নয়াপাড়া বাজার থেকে নজির মেম্বারের বাড়ি হয়ে বাগান পাড়া দিয়া কাশেম মেম্বারের বাড়ি, নয়াপাড়া কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে জাহাঙ্গীর মেম্বারের বাড়ি হয়ে মনু মেম্বারের বাড়ি দিয়া আব্বাস কারবারী পাড়া পুকুর ও রোয়াম্ভু বিজ্র থেকে আবু বক্করের বাড়ি হয়ে মংচপাড়া পার মাতামুহুরী নদী এবং বাবুপাড়া বাজার থেকে বাবুপাড়া কমিউনিটি সেন্টার হয়ে আবু মং কারবারী বাড়ি পর্যন্ত ৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ে এই সড়ক নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। তবে এই কাজে শুধুমাত্র দুর্নীতিই হচ্ছে না করা হচ্ছে পুকুরচুরি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাবুপাড়া বাজার থেকে বাবুপাড়া কমিউনিটি সেন্টার হয়ে আবু মং কারবারী বাড়ি পর্যন্ত সড়ক, নয়াপাড়া বাজার থেকে নজির মেম্বারের বাড়ি হয়ে বাগান পাড়া দিয়া কাশেম মেম্বারের বাড়ি, নয়াপাড়া কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে জাহাঙ্গীর মেম্বারের বাড়ি হয়ে মনু মেম্বারের বাড়ি দিয়া আব্বাস কারবারী পাড়া পুকুর পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ কাজে খোয়ার পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে পুরনো পরিত্যক্ত ইটের টুকরো, মাটি এবং ময়লা-আবর্জনা। বালুর পরিবর্তে মাটি মিশিয়ে রাস্তা ভরাট করা হচ্ছে। তড়িঘড়ি করে যেনতেনভাবে খোঁড়া রাস্তা ভরাট করে রুলিং করা হচ্ছে। বর্ষার এই মৌসুমী রাস্তা নির্মাণ কাজ দেখে মনে হচ্ছে না এটা রাস্তার কাজ চলছে। এই কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক নির্মাণের প্রথম ধাপেই দায়সারাভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে। ফলে রাস্তা নির্মাণ হলেও আদৌ এই রাস্তা জনগনের কাজে আসবে কি না তা নিয়ে সংশয় ও ক্ষোভ জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরার লাইন্সেন্সে সড়ক নির্মাণের কাজটি করছে নোয়াপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির বর্তমান আহ্বায়ক ও যুবদল নেতা আবু বক্কর, আলীকদম উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কফিল উদ্দিন, উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক ১ নং আলীকদম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন। আলীকদম উপজেলার প্রায় সব গুলো উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড পাহাড়িদের নামে করা ঠিকাদারি লাইসেন্স ব্যবহার করে ঠিকাদারি কাজ করে আওয়ামীলীগ-বিএনপির এই ঠিকাদারি সিন্ডিকেট। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের আয়কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য অনেকেই পাহাড়িদের নামে করা ঠিকাদারি লাইসেন্স ব্যবহার করেন।

এ বিষয়ে নয়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফোগ্য মার্মা আমাদের বাণীকে বলেছিলেন, আসলে অনেক কাজে ব্যস্ত থাকি সব সময় এই কাজের খেয়াল রাখা হয়না। তাছাড়া এই কাজ এলজিইডির। এলাকাবাসী আমাদের কাছে প্রায়শই অভিযোগ করে বলেন যে নিন্মমানের খোয়া ব্যবহার করা হচ্ছে যেখানে বালি দরকার সেখানে মাটি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। পুরনো খোয়া ব্যবহার থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনিয়ম হচ্ছে তবে আমি ঠিকাদারকে ডেকে বলেছি কাজটি ভালোভাবে করতে এবনং এলজিইডিকেও জানিয়েছি যাতে তারা ভালোভাবে দেখভাল করেন।

সড়ক নির্মাণে অনিয়মের বিষয়ে আলীকদম উপজেলা এলজিইডি কর্মকর্তা প্রকৌশলী আসিফ আহসান আমাদের বাণীকে বলেন, বর্ষার মৌসুম হওয়ায় ঠিকমত কাজ করা যাচ্ছে না। কাজটা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। অনিয়মের দুই একটি অভিযোগ আমাদের কাছেও এসেছে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আমি আবারও খোঁজ নিচ্ছি যদি কোন ধরণের অনিয়ম আমরা পাই সাথে সাথেই ব্যবস্থা নিব।

এ বিষয়ে আলীকদম উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ঠিকাদার কফিল উদ্দিনের কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি ব্যস্ত আছেন পরে কথা বলবেন বলে জানান। পরে কখন তিনি কথা বলতে পারবেন জিজ্ঞেস করলে তিনি পরে ফোন দেবেন বলে লাইন কেটে দেন।

এ বিষয়ে বিএনপি নেতা ঠিকাদার মো. আবু বক্কর ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক ১ নং আলীকদম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ঠিকাদার জামাল উদ্দিনের বক্তব্য নিতে তার মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা এবং ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোন সাড়া দেননি।

আলীকদম উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ সায়েদ ইকবাল আমাদের বাণীকে বলেন, কাজটি করছে এলজিইডি। এটা ওদের দেখভালের দায়িত্ব। কাজের অনিয়মের বিষয়ে আমার জানা ছিল না আপনাদের মাধ্যমে জানলাম এ জন্য আপনাদেরকে ধন্যবাদ। তবে এই অনিয়মের বিষয়ে আমাদেরকে কেউ যদি লিখিত অভিযোগ দেয় সেক্ষেত্রে আমাদের অভিযান চালাতে সহজ হয়। আমরা খোজ খবর নিব কেউ যদি অনিয়ম করে থাকে তাহলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।

আলীকদম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবু দুংড়িমং মার্মার কাছে জানতে চাইলে তিনি আমাদের বাণীকে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃৃত্বে ও আমাদের মাননীয় মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপির দিকনির্দেশনায় পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড এগিয়ে যাচ্ছে। এখানে কোন কাজেই অনিয়ম করার সুযোগ নেই। আমি নিজেও শুনেছি গ্রামীণ রাস্তা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নয়াপাড়া ইউনিয়নের সড়ক নির্মাণের কাজ অনিময় করা হচ্ছে। পুরনো খোয়া দেয়াসহ নিন্মমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমি এলজিইডি কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। আমি যতদুর জানি এই কাজ আবু বক্কর নামের এক ঠিকাদার করছে। জামাল উদ্দিন ও কফিল উদ্দিন এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত কিনা আমি নিশ্চিত নয়। তবে জামাল উদ্দিন এর আগেও ঠিকাদারি কাজ নিয়ে বিভিন্ন অনিয়মের প্রসঙ্গ আনলে তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজদের কোন দল নেই। এরকম কিছু হলে অবশ্যই আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিব।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.