
বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলীকদম উপজেলার পাহাড়ী-বাঙ্গালী জন সমাজের ঘূর্ণিয়মান অর্থনীতির চাকা এখনো ধীরলয়ে চলছে। বসবাসরত সিংহভাগ লোকজন অর্থনৈতিকভাবে সুযোগসুবিধা এখনো পায়নি। পাহাড়ী ভূমিতে জুম চাষ করে অধিকাংশ উপজাতীয় লোকজন জীবিকা নির্বাহ করেন। সেই আদিম পদ্ধতিতে জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা আহরণ করে এলাকার সবুজ পাহাড়কে শ্মশানের ছাইয়ে পরিণত করলেও অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসেনি তাদের। অপরদিকে, বাঙ্গালী জনসমাজেও খেটে খাওয়া লোকের সংখ্যা বেশী। তবে আলীকদম উপজেলার এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর সুনজর পরলেও কুনজর পরেছে একশ্রেণীর অসাধু চক্রের। জীবনমান উন্নয়নে বরাদ্দ গিলে খাচ্ছে এক শ্রেণির দূুর্নীতিবাজেরা। জীবন-মান পরির্তনের লক্ষ্যে রাস্তাঘাট নির্মাণ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও কাজ হচ্ছে লাখ টাকার আর বাকি টাকা ঢুকছে দূুর্নীবাজদের পকেটে। আলীকদম এলজিইডির আওতাধীন নয়াপাড়া ইউনিয়নের গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ কাজে পুকুরচুরির ঘটনা ঘটছে। গ্রামীণ রাস্তা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ে সড়ক নির্মাণে ৭৮ লাখ টাকাও ব্যয় করা হচ্ছে কি না প্রশ্ন এলাকাবাসীর।
আলীকদম উপজেলা এলজিইডি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে আলীকদম উপজেলা গ্রামীণ রাস্তা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নয়াপাড়া ইউনিয়নে নয়াপাড়া রাস্তার থেকে মংব্রাচিং মার্মা পাড়া হয়ে শৈলকুটি দিয়া নয়াপাড়া বাজার, নয়াপাড়া বাজার থেকে নজির মেম্বারের বাড়ি হয়ে বাগান পাড়া দিয়া কাশেম মেম্বারের বাড়ি, নয়াপাড়া কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে জাহাঙ্গীর মেম্বারের বাড়ি হয়ে মনু মেম্বারের বাড়ি দিয়া আব্বাস কারবারী পাড়া পুকুর ও রোয়াম্ভু বিজ্র থেকে আবু বক্করের বাড়ি হয়ে মংচপাড়া পার মাতামুহুরী নদী এবং বাবুপাড়া বাজার থেকে বাবুপাড়া কমিউনিটি সেন্টার হয়ে আবু মং কারবারী বাড়ি পর্যন্ত ৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ে এই সড়ক নির্মাণে কাজ করছে আওয়ামীলীগ-বিএনপির ঠিকাদারি সিন্ডিকেট। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরার লাইন্সেন্সে সড়ক নির্মাণের কাজটি করছে নোয়াপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির বর্তমান আহ্বায়ক আবু বক্কর, আলীকদম উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কফিল উদ্দিন, উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক ১ নং আলীকদম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন। এই কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক নির্মাণের প্রতিটি ধাপ দায়সারাভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাবুপাড়া বাজার থেকে বাবুপাড়া কমিউনিটি সেন্টার হয়ে আবু মং কারবারী বাড়ি পর্যন্ত সড়ক, নয়াপাড়া বাজার থেকে নজির মেম্বারের বাড়ি হয়ে বাগান পাড়া দিয়া কাশেম মেম্বারের বাড়ি, নয়াপাড়া কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে জাহাঙ্গীর মেম্বারের বাড়ি হয়ে মনু মেম্বারের বাড়ি দিয়া আব্বাস কারবারী পাড়া পুকুর পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ কাজে খোয়ার পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে পুরনো পরিত্যক্ত ইটের টুকরো, মাটি এবং ময়লা-আবর্জনা। বালুর পরিবর্তে মাটি মিশিয়ে রাস্তা ভরাট করা হচ্ছে। তড়িঘড়ি করে যেনতেনভাবে খোঁড়া রাস্তা ভরাট করে রুলিং করা হচ্ছে। বর্ষার এই মৌসুমী রাস্তা নির্মাণ কাজ দেখে মনে হচ্ছে না এটা রাস্তার কাজ চলছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, সড়কের কাজে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করা হচ্ছে। বালুর পরিবর্তে কাদামাটি দিয়ে তার উপর রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া পুরানো ইটের খোয়া ছিটিয়ে এবং খোয়ার পরিবর্তে মাটি, ধুলো-ময়লা ও পুরনো রাবিশ ব্যবহার করা হচ্ছে। বালুর পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে মাটি মিশ্রিত বালু। এমনকি ইটে পা দিয়ে চাপ দিলে তা ভেঙে যাচ্ছে। রাস্তার কাজে স্থানীয় সরকার প্রকৗশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) কাউকে এসে তদারকি করতে দেখা যায়নি। এভাবে কাজ হলে এই সড়ক হবে এই এলাকার মানুষের জন্য অন্যতম দূুর্ভোগের কারণ।
এ বিষয়ে নয়াপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের এক নেতা বলেন, এই কাজের ঠিকাদার ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক, স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা এম কফিল উদ্দিন ও জামাল উদ্দিন। ব্যক্তি স্বার্থে তলে তলে সবাই সমান। এই বিপুল অংকের টাকার সড়ক নির্মাণে অনিময়মে যাতে কেউ বাধা হয়ে না দাড়ায় তার জন্য নেতাদের মেনেজ করেই তিনি এই পুকুর চুরী করছেন। সড়ক নির্মাণের কাজ দেখলেই মনে হবে ভালো সড়ক টাকে কেটে কুটে ভাগাড়ে পরিণত করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আলীকদম উপজেলা আওয়ামীলীগের এক নেতা বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাহাড়ের উন্নয়নে যে পরিমান অর্থ বরাদ্দ দেন তা যদি সম্পূর্ণ কাজ হত তাহলে পাহাড়ের চিত্র বদলে যেত। নয়াপাড়া ইউনিয়নের গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ কাজে প্রায় ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও ওখানে যে কাজ হচ্ছে তা দেখে বোঝার উপায় নেই এটা বড় কোন কাজ। ঠিকাদার আবু বক্কর, এম কফিল উদ্দিন ও জামাল উদ্দিন চেয়ারম্যান আখের গোছাতে ব্যস্ত। উপর মহলে হাত করে মোটা অঙ্কের টাকা গিলে খাচ্ছে। এই সড়ক নির্মাণে এভাবে দূুর্নীতি হলে নির্মিত সড়ক এলাকাবাসীর কোন কাজে আসবে না। তিনি বিষয়টিকে খতিয়ে দেখার আহ্বান জানান।
জানতে চাইলে নয়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফোগ্য মার্মা এর আগে আমাদের বাণীকে বলেন, আসলে অনেক কাজে ব্যস্ত থাকি সব সময় এই কাজের খেয়াল রাখা হয়না। তাছাড়া এই কাজ এলজিইডির। এলাকাবাসী আমাদের কাছে প্রায়শই অভিযোগ করে বলেন যে নিন্মমানের খোয়া ব্যবহার করা হচ্ছে যেখানে বালি দরকার সেখানে মাটি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। পুরনো খোয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনিয়ম হচ্ছে তবে আমি ঠিকাদারকে ডেকে বলেছি কাজটি ভালোভাবে করতে এবনং এলজিইডিকেও জানিয়েছি যাতে তারা ভালোভাবে দেখভাল করেন।
তবে এ বিষয়ে ঠিকাদার আবু বক্কর, এম কফিল উদ্দিন ও জামাল উদ্দিন চেয়ারম্যানের বক্তব্য নিতে তাদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা এবং ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তারা কোন সাড়া দেননি।
আলীকদম উপজেলা এলজিইডি কর্মকর্তা প্রকৌশলী আসিফ আহসান আমাদের বাণীকে বলেন, বর্ষার মৌসুম হওয়ায় ঠিকমত কাজ করা যাচ্ছে না। কাজটা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। অনিময়মের দুই একটি অভিযোগ আমাদের কাছেও এসেছে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আমি আবারও খোঁজ নিচ্ছি যদি কোন ধরণের অনিয়ম আমরা পাই সাথে সাথেই ব্যবস্থা নিব।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০২০ সালে লকডাউনের সুযোগে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) আলীকদম উপজেলায় তিন কোটি ৫৮ লাখ টাকা ব্যয়ে আলীকদম-পোয়ামুহুরী হয়ে জানালীপাড়া পর্যন্ত ৫ কিলিমিটার সড়ক মেরামতে ব্যপক অনিয়ম ও দূুর্নীতি করে আওয়ামীলীগ-বিএনপির এই ঠিকাদারি সিন্ডেকেট। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরার লাইন্সেন্সে সড়ক মেরামতের কাজটি করে নোয়াপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির বর্তমান আহ্বায়ক আবু বক্কর, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কফিল উদ্দিন, উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক ১ নং আলীকদম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন। যেখানে এই সড়ক মেরামতে খোয়ার বদলে পুরনো দেয়ালের সিমেন্ট মিশ্রিত ভাঙ্গাচোরা পরিত্যক্ত সরঞ্জাম ব্যবহার করে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে আলীকদম থানা পরিষদ প্রকল্পের নামে দুই হাজার মিটার থানা পরিষদ সড়ক মেরামতের কাজটি বাস্তবায়ন করে -হোসাইন অ্যান্ড কোং ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঠিকাদার আবু বক্কর। নির্মাণের এক সপ্তাহের মধ্যে দুই দিনের বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় মেরামত করা রাস্তার কার্পেটিং। আর এই কাজে ঠিকাদার আবু বক্করের অংশীদার ছিলেন জামাল উদ্দিন।
Leave a Reply