‘বড় ভাইদের’ আস্কারায় বেপরোয়া কিশোর গ্যাং

কিশোর গ্যাং

নেপথ্যে থাকা কথিত ‘বড় ভাইদের’ আস্কারায় রাজধানীসহ সারা দেশে কিশোর গ্যাংগুলো বেপরোয়া ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। ছোট ছোট অপরাধ থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, ইভটিজিং, ছিনতাই ও মাদকাসক্ত এসব বখাটেদের উৎপাত বেড়েই চলেছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তারা নিজেদের মধ্যে যেমন দ্বন্দ্বে লিপ্ত, তেমনি তাদের কর্মকাণ্ডে এলাকাবাসীও আতঙ্কিত।

পাড়া-মহল্লা-বস্তির ছিঁচকে অপরাধী থেকে শুরু করে ধনীর দুলাল, এমনকী স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও জড়িয়ে পড়ছে গ্যাংবাজিতে। রাজধানীতে প্রায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং রয়েছে, তাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় এক হাজার। এর বাইরে বিভাগীয় ও জেলা শহরেও কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বাড়ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে প্রায়ই বিভিন্ন গ্রুপের সদস্যরা গ্রেফতার হলেও পেছনে থেকে পৃষ্ঠপোষকতা ও আস্কারা দেয়া রাজনৈতিক দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধি নামধারী ‘বড় ভাইরা’ থেকে যাচ্ছেন অধরা। অভিযোগ রয়েছে, এসব কিশোর গ্যাংকে পেছন থেকে সমর্থন দেয় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের একাংশ। তারা ‘বড় ভাই’ হিসেবে এই কিশোরদের কাজে প্রভাব বিস্তার করে থাকেন।

nagad
সবশেষ সোমবার রাজধানীর হাজারীবাগ ও দারুস সালাম থেকে কিশোর গ্যাং এর দুটি গ্রুপের ১৬ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-২। র‌্যাব-২ এর এএসপি ফজলুল হক জানান, নানা অপরাধে জড়িত কিশোর গ্যাংয়ের ‘ডন সাগর গ্রুপ’ ও ‘মুন্না গ্রুপ’-এর ওই সদস্যদের দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়।

গত এক মাসে তালিকাভুক্ত ১১টি কিশোর গ্যাংয়ের মোট ৬২ জন গ্রেফতার হয়েছে। গত শুক্রবার শ্যামপুরের ধোলাইপাড় এলাকা থেকে ছুরি-চাকুসহ ‘সেভেন স্টার’ ও ‘রবিন হুড’ নামের দুই গ্রুপের ১০ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এর আগের দিন শনিরআখরায় ইস্টার্ন সিটি মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ৩ কিশোরের উপর হামলা চালায় ১০/১২ জন কিশোর। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তাদের কয়েকজনের হাতে ছিল ছুরিসহ ধারালো অস্ত্র। পরে ওই গ্রুপের সদস্যদের গ্রেফতার করে পুলিশ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাজধানীতে প্রায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং রয়েছে। গড়ে প্রতিটির সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ জন। উত্তরা, মিরপুর, পল্লবী, রমনা, মতিঝিল, তুরাগ, খিলগাঁও, দক্ষিণ খান, টঙ্গী, সূত্রাপুর, ডেমরা, সবুজবাগ, খিলক্ষেত, কোতোয়ালি, মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডি আগারগাঁও, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, ওয়ারি, লালবাগ ও হাতিরঝিল থানা এলাকায় এরা বেশি সক্রিয়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারি দলের মাঠপর্যায়ের কতিপয় রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধি কিশোর গ্যাংগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন। উগ্র কিশোরদের ব্যবহার করে চাঁদাবাজি ও এলাকার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাসহ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করছেন ওই ‘বড় ভাইরা’। ছোট খাটো সমস্যায় পড়লে তা তারা সামাল দেন।

ডিএমপি সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানায় কিশোর গ্যাং সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৫৬টি। আর চলতি বছরের গত সাড়ে ৫ মাসে কিশোর অপরাধকেন্দ্রিক মামলার সংখ্যা ১০টি। গত প্রায় দুই বছরে এসব কিশোর গ্যাং সদস্যদের সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে প্রাণ গেছে অন্তত ১৮ জনের। রাজধানীতে গ্যাং কালচারে সবচেয়ে বেশি প্রায় ১০০ সদস্য নিয়ে ‘বিগ বস’ ও ‘নিউ নাইন স্টার’ গ্রুপ গড়ে উঠেছে উত্তরার। সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে বৃহত্তর মিরপুর এলাকায়। আর সবচেয়ে কম গুলশানে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, রাজধানীর মিরপুরে সক্রিয় অন্তত ১৫টি গ্রুপ। এগুলো হলো- অপু, আব্বাস, নাডা ইসমাইল, হ্যাপি, বগা হৃদয়, ভাস্কর, রবিন, এল কে ডেভিল বা বয়েজ এল কে তালতলা, পটেটো রুবেল, অতুল, আশিক, জল্লা মিলন, রকি, পিন্টু-কাল্লু ও মুসা হারুন ওরফে ভাই ভাই গ্রুপ।

উত্তরায় মোট ৯টি গ্রুপ- নাইন স্টার, এইচবিটি বা হিটার বয়েজ, সানি, ইয়ংস্টার, বিগ বস, রানা ভোলা কিং মহল, জিদান, দি বস (হৃদয় গ্যাং)। রমনায় ৫টি গ্রুপ- বেইলি কিং রন, অলি, বাংলা, পারফেক্ট গ্যাং স্টার এবং লাড়া-দে। ওয়ারীতে রয়েছে- শুক্কুর, লিটন, তাহমিদ ও সাঈদ গ্রুপ। ব্যাংকপাড়া মতিঝিল এলাকায় রয়েছে ৬টি- মিম গ্রুপ, চাঁন যাদু, ডেভিল কিং, ফুল পার্টি, জিসান গ্রুপ ও বিচ্ছু বাহিনী।

মোহাম্মদপুরে পাটোয়ারী, আতঙ্ক, চাপায়-দে, ফিল্ম-ঝিরঝির, লারা-দে, টোয়েন্টিফাইভ, লেভেল হাই, দেখে ল চিনে ল এবং কোপাইয়া দে গ্রুপ অন্যতম। ধানমণ্ডির ফাইভ স্টার, একে ৪৭ এবং নাইন এম এম; রায়েরবাজার এলাকার মোল্লা রাব্বি ও স্টার বন্ড গ্রুপ। হাজারীবাগে বাংলা গ্যাং, গেণ্ডারিয়ায় লাভলেট, চকবাজারে টিকটক, তুরাগে তালাচাবি; কাফরুলের ইব্রাহিমপুরে নয়ন; দক্ষিণখানে শাহীন-রিপন; উত্তরখানের বড়বাগের নাজিমউদ্দিন; আটিপাড়ার শান্ত ও মেহেদী, মুগদায় চান-জাদু, ডেভিল কিং ফুল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভাণ্ডারি গ্যাং; এবং বংশালে ‘জুম্মন গ্যাং’ উল্লেখযোগ্য।

স্থানীয় সূত্রমতে, মিরপুরের শাহআলী এলাকায় নেতৃত্ব দিচ্ছে ইরফান ওরফে রাসেল, বিপুল, বাবু ওরফে রোহিঙ্গা বাবু, ভাস্কর ও আরিফ। এর মধ্যে বাবু ওরফে রোহিঙ্গা বাবু শাহআলী থানার ছিন্নমূল হকার্স লীগের সভাপতি পদে রয়েছেন। এ ছাড়াও মিরপুর-১ এলাকার ধানক্ষেতের মোড়ে একাধিক মামলার আসামি ভাস্কর।

মিরপুর-২-এর ৬০ ফিট এলাকার মাসুদ রানা মূলত ওই এলাকার বাজার ও লেগুনা পরিবহন সংশ্লিষ্ট চাঁদাবাজি, মাদক ও অন্যান্য অপরাধে কিশোর গ্যাংকে ব্যবহার করে থাকেন। মিরপুর ১১ এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রকদের অন্যতম ইমরান তালুকদার ওরফে লাদেন সোহেল। কাউন্সিলর মানিক ও জুয়েল রানার হয়ে মিরপুর সেকশন ১০-এ কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে ছাত্রদল নেতা পল্টনের বিরুদ্ধে। বিহারি নেতা সহোদর আবরার ও নেয়াজ কাউন্সিলর মানিক ও জুয়েল রানার হয়ে কাজ করেন। অন্যদিকে মিরপুর গোলচক্কর থেকে শুরু করে হোপ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল পর্যন্ত ফুটপাত দখল করে দোকান ভাড়া দেন পল্টন ও বাপ্পি।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) ডিআইজি কৃষ্ণপদ রায় বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ ঠেকাতে রাজধানীতে প্রোঅ্যাকটিভ পুলিশিং করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ওসিদের। এসবে জড়িত কিশোরদের সুপথে আনতে আমরা উঠান বৈঠকসহ মোটিভেশনাল কাজে জোর দিচ্ছি।

তিনি বলেন, শুধু পুলিশ একা নয়, যারা সমাজ নিয়ে ভাবেন তাদের সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিতভাবে কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে কাজ করতে হবে। অভিভাবকদের উচিত হবে সমস্যা লুকিয়ে না রেখে তারা যেন যথাসময়ে পুলিশের সহায়তা নেন।

বিভাগীয় ও জেলা শহরেও কিশোর গ্যাং কালচার চালু হয়েছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, বাগেরহাট ও যশোরসহ অনেক জেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের অনেক সদস্য।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিশোর গ্যাংয়ের অধিকাংশ সদস্যই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া। তারা ফেসবুক গ্রুপে নৃশংস বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। পরে দল বেঁধে মাঠে চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও নিরীহদের মারধর করে বেড়ায়। ফেসবুকের মাধ্যমে তারা অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দলে ভেড়ানোরও চেষ্টা করে থাকে। একটি গ্রুপ যখন আরেকটির উপর আক্রমণ করে তখন সহযোগিতায় অন্যান্য গ্রুপও এগিয়ে আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এর কারণ নিরূপণ করা জরুরি। নানা কারণে কিশোররা বিপথে ধাবিত হয়। এজন্য সমাজে অপরাধপ্রবণতা হ্রাস, মাদকের সহজলভ্যতা বন্ধ, দারিদ্র্য বিমোচন এবং মানবিক আচরণ জরুরি।

তিনি আরো বলেন, প্রশাসনের উচিত হবে কিশোর অপরাধীদের প্রতি আরো নজরদারি বাড়ানো। এ ছাড়া অভিভাবকদের সচেতনতার পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠান অয়োজনের ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনার পাশাপাশি শিক্ষকদের মোটিভেশনাল ভূমিকা পালন করতে হবে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.