বিপজ্জনক জাহাজ কেনায় সংকটে দেশের ভাবমূর্তি

মোজাম্বিকের নাকালা বন্দর থেকে দেড় বছর আগে ‘ডোনা ভি’ নামে সাড়ে ২৫ হাজার মেট্রিক টন ক্লিংকারবাহী জাহাজ গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে যায়। পরে জাহাজটি দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কার কলম্বো পোর্টের আন্তর্জাতিক সীমানায় (ওপিএল) অবস্থান নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে জাহাজটির মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সীতাকুণ্ডের মাহিনূর শিপ রিসাইক্লিং নামের জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডে বিক্রি করা দেয়ার অভিযোগ ওঠে। আর এ ফেরারি জাহাজ আমদানি করায় ভাবমূর্তির সংকটে পড়তে পারে বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্প। এজন্য এ খাতের ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা চড়া মাশুল দিতে হবে বাংলাদেশকে।

সূত্রমতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ক্লিংকার ক্যারিয়ার হিসেবে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত ছিল ডোনা ভি। জাহাজটি সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট সৌদি আরবের কিং আবদুল্লাহ বন্দর থেকে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান সিমেন্টস মোজাম্বিকের কেনা সাড়ে ২৫ হাজার মেট্রিক টন ক্লিংকার নিয়ে মোজাম্বিকের বিয়েরার নাকালা বন্দরের দিকে রওনা হয়। জাহাজটি ইয়েমেনের এডেন বন্দরে যাত্রাবিরতিকালে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী হুতির মিসাইলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জাহাজটিতে থাকা ক্লিংকার নষ্ট হয়ে যায়। পরে জাহাজটি মেরামত করার পর আবারও মোজাম্বিকের উদ্দেশে রওনা হয়। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর মোজাম্বিকের নাকালা বন্দরের পৌঁছে। কিন্তু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ক্লিংকার বিনষ্ট হওয়ার অভিযোগে পণ্য খালাসে অনীহা প্রকাশ করে। পাশাপাশি জাহাজ আটক রেখে জাহাজের মালিক ও রপ্তানিকারকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করে। কিন্তু রাতের অন্ধকারের মালিকের নির্দেশে জাহাজের ক্যাপ্টেন জাহাজ নিয়ে পালিয়ে যান।

এর পর থেকে বারবার জাহাজটি নাম-পতাকা পরিবর্তন করে আমদানিকারক কর্তৃক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ফাঁকি দিয়ে সর্বশেষ শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরের আন্তর্জাতিক সীমানায় (ওপিএল) অবস্থান নেয়। এর মধ্যে জাহাজটিতে থাকা বর্জ্য সমতুল্য চোরাই ক্লিংকার বিভিন্ন পার্টির কাছে বিক্রির চেষ্টা করা হয়। পাশাপাশি জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করার পর ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ক্রেতাদের কাছে বিক্রির চেষ্টা করা হয়। সর্বশেষ দুবাইয়ের ভিরানার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রভাবশালী ও মাফিয়া চক্রর কাছে চক্রটি এটি বিক্রি করে। আর চক্রটি দেশীয় এজেন্ট এএইচজেড শিপিংয়ের মাধ্যমে জাহাজটি আগমন ঘোষণা করে। বর্তমানে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের আউটার এনকারেজে অবস্থান করছে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের এসএম নুরুন নবীর মালিকানাধীন মাহিনূর শিপ রি-সাইক্লিং লিমিটেড নামে একটি জাহাজ ভাঙা প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরভিত্তিক ডেমো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড থেকে প্রায় ৩৪ কোটি টাকায় এটি কিনে নেয়, যার স্থানীয় শিপিং এজেন্ট ছিল আগ্রাবাদ এলাকার এএইচজেট শিপিং লাইনস। ক্যারিবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্র সেন্ট কিডস অ্যান্ড নেভেসের পতাকাবাহী আট হাজার ১৩১ মেট্রিক টনের জাহাজটি শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর থেকে গত ১২ মে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরের এনকারেজে সিতে প্রবেশ করে। আর জাহাজটির এলসি করা হয় ব্যাংক এশিয়ার পল্টন শাখা থেকে।

বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) সদস্য ও একাধিক জাহাজ ভাঙা ব্যবসায়ীরা বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ডোনা ভি’র মতো ফেরারি জাহাজ কেনার সুযোগ নেই। আর কেউ চোরাই জাহাজ কিনলে তাতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, যার চড়া মাশুল এ খাতের ব্যবসায়ীদের দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে আরও সচেতন হতে হবে। যদিও করোনার সুযোগ নিয়ে একটি চক্র বর্তমানে দুই রিগ জাহাজ আমদানি করেছে। এগুলো নিয়েও ঝামেলা চলছে। আর বিষয়টি সমাধানের জন্য সিঙ্গাপুরের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা চট্টগ্রামের অবস্থান করছেন। তাদের প্রচুর অর্থের লোভ। এক্ষেত্রে সরকারি সংস্থারগুলোকে আরও সতর্ক ও সচেতন হতে হবে।

জাহাজ ভাঙা শিল্প-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, ডোনা জাহাজটি বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থান করছে। জাহাজটির ক্লিংকার শ্রীলঙ্কার লাফার্জ সিমেন্টের কাছে বিক্রি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার পরিচালক মফিদুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ডোনা ভি নামের জাহাজের এনওসি নেয়ার জন্য এখন পর্যন্ত কেউ আবেদন করেনি।

এ বিষয়ে কোস্টগার্ড ইস্ট জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হাবিবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা এ ধরনের খবর পায়নি। আর কাস্টমসে সব ডকুমেন্টস জমা দেয়া পর এ ধরনের জাহাজ বাংলাদেশের নৌ সীমান্তে প্রবেশ করতে পারে। সাধারণত চোরাই ও নিষিদ্ধ পণ্য থাকলে আমরা জাহাজ জব্দ করি। আর ফেরারি জাহাজ হলে তখন আদালত, বন্দর কিংবা অন্য কোনো সরকারি সংস্থা নির্দেশ থাকলে তখন জব্দ করতে পারি। এখন যেহেতু এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়নি, সেহেতু আমাদের কিছুই করার নাই।’

এ বিষয়ে নৌ-বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ডোনা ভি জাহাজটি সৈকতায়ন করার জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন নেয়নি। এছাড়া কয়েক বছর ধরে অধিকাংশ জাহাজ ভাঙার প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছ থেকে সৈকতায়নের অনুমতি নেয় না, যা আইনের লঙ্ঘন। তিনি আরও বলেন, ডোনার বিরুদ্ধে যদি গ্রেপ্তারি আদেশ থাকে, তাহলে এ ধরনের বিরোধপূর্ণ জাহাজ আমদানির সুযোগ নেই। পাশাপাশি কাটারও সুযোগ নেই।

অপরদিকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ, বিরা, বেখা এবং বিআইএম) জাফর উল্লাহ্ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এ ধরনের তথ্য তো আমরা পাইনি। আর সংশ্লিষ্টরাও অভিযোগ করেনি। প্রতিকারের জন্য অবশ্যই অভিযোগ তো করতে হবে। এখন তথ্য-প্রযুক্তির যুগ। তখন আমরা ব্যবস্থা নেব।’

এ বিষয়ে মাহিনূর শিপ রি-সাইক্লিং লিমিটেড স্বত্বাধিকারী এসএম নুরুন নবী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আসলে তো আমরা ভিরানার বাংলাদেশি এজেন্ট ডেমো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড থেকে জাহাজ কিনছি। আর এ ধরনের জাহাজ তো বহুবার হাতবদল হয়ে থাকে। ফলে আমাদের পক্ষে ইতিহাস জানার সুযোগ হয় না। আর ডোনা ভি’র গ্রেপ্তারের বিষয়ে কিছুই জানি না। একই সঙ্গে জাহাজের ক্লিংকার পাওয়া যায়নি। তবে আমার কাছে সব ধরনের সরকারি ডকুমেন্টস আছে, আপনি চাইলে দেখতে পারেন।’

নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তরের সৈকতয়ানের অনুমতি না নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ দপ্তর থেকে অনুমতি নেয়া হয় কি না, তা আমি জানি না। তবে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সৈকতায়ন প্রসঙ্গে অনুমোদন নেয়া হয়। আর পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি অবশ্যই নেয়া হয়। তা না হলে তো কাস্টমসে বিল অব এন্ট্রি সাবমিট করতে পারব না। এটা যিনি বলেছেন, তিনি হয়তো অবগত নন। আমার কাছে সব ধরনের ডকুমেন্টস আছে।’

উল্লেখ্য, জাহাজ ভাঙা ব্যবসায়ী এসএম নুরুন নবীর মালিকানাধীন প্রিমিয়ার ট্রেড করপোরেশন লিমিটেড তিনটি জাহাজ এবং মাহিনূর শিপ রি-সাইক্লিং লিমিটেড দুটি জাহাজ আমদানি করেছিল। আর পাঁচটি জাহাজের মোট ওজন ছিল ৫৭ হাজার ৫৬৫ মেট্রিক টন।

যোগাযোগ করা হলে জাহাজ ভাঙা শিল্পের ফ্রিল্যান্স পরামর্শক হাবিবুল মোমেন শেয়ার বিজকে বলেন, একটি বিপজ্জনক জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর এবং স্ক্র্যাপ করার চেষ্টা চলছে। এটি একটি রহস্যময় জাহাজ। এর মধ্যে বিপজ্জনক সিমেন্ট ক্লিংকার রয়েছে বলে জানা গেছে। সঠিকভাবে খোঁজ-খবর না নিয়ে এটিকে বন্দরের ছাড়পত্র দেয়া হলে তা দেশের জন্য ক্ষতি বয়ে আনবে। সুত্রঃ শেয়ার বিজ

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.