
রাজধানীর বৃহত্তর মিরপুর এলাকা জুড়ে কিশোরগ্যাংয়ের তৎপরতা ভয়াবহ ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিশোরগ্যাংয়ের সদস্যদের ব্যবহার করে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়াচ্ছে কতিপয় কিছু নেতা। সম্প্রতি বৃহত্তর মিরপুর এলাকা নিয়ে চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, কিশোরগ্যাংয়ের নেতাদের একটি তালিকা তৈরী করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর তালিকা ধরেই অভিযান শুরু হচ্ছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে বুধবার রাতে মিরপুর, শেরেবাংলা নগরসহ কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৮ জন কিশোরগ্যাংয়ের সদস্যকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ।
জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর যুবলীগের সহ-সভাপতি কাজী জহিরুল ইসলাম মানিক রাজধানীর মিরপুরে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, ডিশ ব্যবসা, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করছেন। এমনকি নারীকে ধর্ষণ ও এক জুট ব্যবসায়ীকে হত্যার অভিযোগও রয়েছে কাউন্সিলর মানিকের বিরুদ্ধে।
সূত্র জানায়, কাউন্সিলর মানিক, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা জুয়েল রানা ও ৩ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আমান উল্লাহ আমানের ছত্রছায়ায় পল্লবীতে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং। প্রতিটা কিশোর গ্যাং প্রধানদের ভিন্ন ভিন্ন অপরাধে ব্যবহার করেন কাউন্সিলর মানিক ওরফে বোমা মানিক। মিরপুর ১১ তে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে ইমরান তালুকদার ওরফে লাদেন সোহেল । হোসেন মনির বাবু ওরফে পিস্তল বাবু, ছাত্রদল নেতা আশরাফ, জামাত নেতা শামিমের ছেলে মুস্তাকিম হোসেন ফয়সাল,কূখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী আরমান, তালিকাভূক্ত মাদক ব্যবসায়ী ও হত্যা মামলার আসামি লেঙরা রুবেল, সন্ত্রাসী তানভিরসহ তালুকদার বাহিনীতে রয়েছে অর্ধ শতাধিক কিশোর ও যুবক। মূলত মাদক ব্যবসা, জমি দখল, প্রতিপক্ষকে সায়েস্তা করার কাজে তালুকদার বাহিনীকে ব্যবহার করেন মানিক।
কাউন্সিলর মানিক ও জুয়েল রানার হয়ে মিরপুর সেকশন ১০ এর কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রদল নেতা পল্টন । এ গ্যাংয়ে মাদক ব্যবসায়ী মফিজ ও শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী রাজিব, মিজান, বাপ্পিসহ প্রায় ২০০ এর অধিক যুবক কিশোরদের নিয়ে এক বিশাল বাহিনী গড়ে তুলেছে ছাত্রদল নেতা পল্টন। পল্টন বাহিনীকে ওয়াপদাহ বিহারি ক্যাম্পের মাদক ব্যবসা ও ফুটপাত দখল করে দোকান ভাড়া দেয়ার কাজে ব্যবহার করেন এ বিতর্কিত জনপ্রতিনিধি কাজী মানিক। মাঠে মাদক বিক্রি ও বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে মাদক ব্যবসায়ী মফিজ ও শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী রাজিব। ওয়াপদাহ কলোনীর মাদক ব্যবসায়ীদের দেখভাল করেন বিহারি নেতা আবরার ও নেয়াজ। নেয়াজ ও আবরার দুই ভাই। এক ভাই কাজ করেন কাউন্সিলর মানিকের জন্য এবং অন্য ভাই কাজ করেন জুয়েল রানার জন্য । কোনো মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হলে তাকে তাৎক্ষনিক ছাড়িয়ে আনার দায়িত্ব পালন করেন তথাকথিত এ দুই বিহারি নেতা । অন্যদিকে মিরপুর গোলচক্কর থেকে শুরু করে হোপ ইন্টার ন্যাশনাল স্কুল পর্যন্ত ফুটপাত দখল করে দোকান ভাড়া দেন পল্টন ও বাপ্পি। সেখানে দোকান করতে চাইলে ১ লাখ টাকা অগ্রিম ও মাসে ৯ হাজার টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। এসব টাকা কালেকশন করে ছাত্রদল নেতা পল্টন ও বাপ্পি। এ টাকাও যায় কাউন্সিলর মানিকের পকেটে।
অভিযোগ রয়েছে সম্প্রতি র্যাবের সাথে হওয়া বন্দুকযুদ্ধে নিহত শীর্ষ সন্ত্রাসী মহসীনের সঙ্গেও সক্ষতা ছিল কাউন্সিলর মানিকের। মূলত ভোট কেন্দ্র দখল করার কাজে মহসীনকে ব্যবহার করতেন মানিক। চাঁদাবাজি, দকলবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ থাকায় ২০১৯ সালের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মানিককে দল থেকে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে কিলার মহসীনের উপর ভর করে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন বোমা মানিক। এসময় আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী জিন্নাত মাদবরকে বেশ কয়েকবার মারধর করে মানিক সমর্থকরা।
এক নারীকে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগও এ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। ভূক্তভোগি ওই নারি জানান, প্রথমে সালিশের কথা বলে আমার স্বামীকে তালাক দিতে বাধ্য করে কাউন্সিলর মানিক। পরে কৌশলে সে আমাকে কুপ্রস্তাব দেয়। ওইসময় আমি রাজি না হলে পরে আমাকে বিয়ের আশ্বাস দেয়। এরপর দীর্ঘদিন আমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে। প্রায় দেড় বছর এভাবেই সে আমাকে ভোগ করে। কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা মানিকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রস্ততি নিচ্ছেন বলেও জানান ওই ভুক্তভোগী নারী।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর রাজধানীর প্যারিস রোডে মোহন নামের এক জুট ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনায় ১২ জনকে আসামি করে পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের স্ত্রী। ওই সময় মামলার এজাহারভুক্ত মিজানুর রহমান ঝিনুককে গ্রেফতার হলেও এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। পরে মামলার তদন্ত ভার দেয়া হয় সিআইডিকে। সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা এ ঘটনায় আরো ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। পরে আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে কাউন্সিলর মানিক ও শীর্ষ সন্ত্রাসী মহোসিনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। পরে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার প্রস্তুতি নিলেও অদৃশ্য চাপের মূখে প্রতিবেদনটি আদালতে পাঠাতে পারেনি সিআইডি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, অপরাধী এবং অপরাধীদের শেল্টারদাতা সবাই আমরা সমানভাবে চিহ্নিত করে। কিশোরগ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযান চলছে।
যুবলীগ ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে থাকলেও নিজেকে উত্তরের সিনিয়র সহ-সভাপতি বলে দাবি করেন কাউন্সিলর মানিক। পল্লবীসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবেই ব্যানার ফেস্টুন টানিয়েছেন মানিক। শুধু পল্লবীতেই নয় যুবলীগের এ পরিচয় ব্যবহার করে ব্যবহার করে রাজধানী জুড়েই অপ-তৎপরতা চালনোর অভিযোগ রয়েছে মানিকের বিরুদ্ধে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল জানান, মানিক যুবলীগ উত্তরের সিনিয়র সহ-সভাপতি নয়। সে শুধু সহ-সভাপতির দায়িত্বে রয়েছে। দলের কেউ অপরাধ করে তাহলে সেটার দায় তো আর দল নেবে না। তবে দলের নাম ব্যবহার করে কেউ চাঁদাবাজি ও দখলবাজি করতে পারেনা। কোনো ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ করলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের শীর্ষ এ নেতা।
সকল অভিযোগ অস্বীকার করে মানিক বলেন, আমি এগুলো কোনটারই সঙ্গে জড়িত না। প্রতিপক্ষরা মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে।
Leave a Reply