
ডেল্টা ধরনের কারণে দেশে করোনা সংক্রমণের হার উর্ধমুখী। সীমান্তের জেলাগুলোতে সংক্রমণের উচ্চ হারের কারণেই মঙ্গলবার সারাদেশে গত এক মাসে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। অতি সংক্রামক এই ধরন রুখতে করোনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো এবং দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনার পরিকল্পনাও করছে সরকার। এছাড়া অঞ্চলভিত্তিক লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশও দেয়া হয়েছে সরকার থেকে। বর্তমানে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের হটস্পট উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে বিনামূল্য করোনা পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কর্মজীবী মানুষ বিশেষ করে শ্রমিকদের করোনা শনাক্তে র্যাপিড এ্যান্ট্রিজেন টেস্টের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণেই মঙ্গলবার দেশে সর্বোচ্চ নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে ১২.১২ শতাংশ হারে রোগী শনাক্ত হয়েছে। ৭ জুন ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়। ৬ জুন সংক্রমণের হার ছিল ১০.৭৩ শতাংশ। গত ৫ জুন দেশে নতুন ১১.০৩ শতাংশ হারে সংক্রমণের ঘটনা ঘটে। ৪ জুন এই হার ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ ও ৩ জুন ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ হারে সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল। গত মাসে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে ৬ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছিল। ঈদের ছুটির পর হঠাৎ করেই সংক্রমণের হার উপরে উঠতে থাকে।
গত ৬ জুন ঢাকা বিভাগে করোনা শনাক্তের হার ছিল ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগে ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ২৫ দশমিক ১৮ শতাংশ, রংপুর বিভাগে ২৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ ও সিলেট বিভাগে ১৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
গত ৭ জুন ঢাকা বিভাগে সংক্রমণের হার দাঁড়ায় ৫ দশমিক ০২ শতাংশ, ময়মনসিংহে ১০ দশমিক ১৬ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ১৮ দশমিক ১৫ শতাংশ, রংপুর বিভাগে ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ৩০ দশমিক ৩৩ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে ১৫ দশমিক ১৮ শতাংশ ও সিলেট বিভাগে ১৬ দশমিক ৭৭ শতাংশে।
রাজশাহী বিভাগে সর্বোচ্চ মৃত্যু ও শনাক্ত ॥ রাজশাহী বিভাগে এক দিনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত ও আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হয়েছে। মঙ্গলবার বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক নাজমা আক্তারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৬৭৩ জন। মারা গেছেন ১২ জন। গত বছর বিভাগে সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এক দিনে এতসংখ্যক রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটল।
গত ২৪ ঘণ্টায় বিভাগের আট জেলায় পিসিআর ল্যাব, র্যাপিড এ্যান্টিজেন ও জিন এক্সপার্ট মেশিনে মোট ৪ হাজার ১৩৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে ৬৭৩ জনের করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ২৬ শতাংশ।
রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মঙ্গলবারের প্রতিবেদন অনুযায়ী সোমবার সকাল আটটা থেকে মঙ্গলবার সকাল আটটা পর্যন্ত নতুন শনাক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে রাজশাহী জেলার ২৯৯ জন। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৮৯, নওগাঁয় ৩৬, নাটোরে ৪২, জয়পুরহাটে ৫২, বগুড়ায় ২৫, সিরাজগঞ্জে ১৭ ও পাবনার বাসিন্দা ১৩ জন।
খুলনায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার উর্ধমুখী ॥ খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পিসিআর ল্যাবে মঙ্গলবারে একদিনে সর্বোচ্চ ১৩১ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। আর খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আওতাধীন খুলনা করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালেও বেড খালি নেই। ১০০ বেডের হাসপাতালেও মঙ্গলবার সর্বাধিক ১২৯ রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত মারা গেছেন ৫ জন। এছাড়া বাগেরহাট, মোংলা, যশোর, কুষ্টিয়াতে করোনা সংক্রমণের হার উর্ধমুখী রয়েছে।
সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় বিভাগে শনাক্ত হওয়া ৬৯ জনের মধ্যে সিলেট জেলার ৪৮ জন, সুনামগঞ্জের চারজন, হবিগঞ্জের ৬ জন ও মৌলভীবাজারের ১১ জন। বিভাগের মধ্যে সিলেট জেলায় ১৫ হাজার ২৫৮ জন, সুনামগঞ্জের ২ হাজার ৮৪৭ জন, হবিগঞ্জের ২ হাজার ৫৩২ জন ও মৌলভীবাজারের ২ হাজার ৫৮৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ দিকে বিভাগে সুস্থ হয়েছেন ২১ হাজার ৭৭৯ জন।
এক মাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু ॥ ২৪ ঘণ্টায় মৃত ৪০ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে রয়েছেন ১১ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে সাতজন, খুলনা বিভাগে ছয়জন, রাজশাহী বিভাগে ১১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে দুইজন, সিলেট বিভাগের দুইজন ও রংপুর বিভাগে পাঁচজন রয়েছেন। এদের মধ্যে সরকারী হাসপাতালে মারা গেছেন ৩৭ জন, বেসরকারী হাসপাতালে তিনজন ও বাড়িতে চারজন রয়েছেন। মৃতদের বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬০ বছরে উর্ধে ২৬ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ১০ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে তিনজন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের নিচে চারজন, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে একজন রয়েছেন।
করোনা প্রতিরোধে পরীক্ষার বিকল্প নেই অভিহিত করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, উত্তরের বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, এই অঞ্চলে বসবাসরত প্রচুর নি¤œ আয়ের মানুষ আর্থিক কারণে কোভিড পরীক্ষা করাতে চান না। তাই পরীক্ষার খরচ যদি মওকুফ করা হয়, তাহলে তারা এ বিষয়ে উৎসাহিত হবেন। এই পরিস্থিতিতে সরকার এমন উচ্চ সংক্রমণের জেলাগুলোতে কিছুদিনের জন্য বিনামূল্যে কোভিড পরীক্ষার পরিকল্পনা করছে বলে জানান জাহিদ মালেক। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা যদি ১০টি পরীক্ষা করি, আর তাতে যদি পাঁচটির ফল পজিটিভ আসে, তার মানে হলো শনাক্তের হার ৫০ শতাংশ। যা প্রকৃত অবস্থাকে তুলে ধরে না। তাই বৈঠকে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। একইসঙ্গে তিনি বলেন, পরিবহন শ্রমিকরা যেহেতু সারাদেশে যাতায়াত করেন, তাই তাদের করোনা পরীক্ষার জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের কোভিড পরীক্ষা করা হবে এ্যান্টিজেন র্যাপিড টেস্টের মাধ্যমে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ৫০৯টি পরীক্ষাগারে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এর মধ্যে আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে হচ্ছে ১৩১টি পরীক্ষাগারে, জিন এক্সপার্ট মেশিনের মাধ্যমে ৪৪টি পরীক্ষাগারে এবং র্যাপিড এ্যান্টিজেনের মাধ্যমে ৩৩৪টি পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সীমান্তবর্তী যেসব জেলায় সংক্রমণ বেশি, সেখানে কঠোর লকডাউন জোরদার করতে হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে করোনার নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে হবে, রোগী শনাক্ত এবং কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করে ব্যবস্থা নিতে হবে। করোনা পরীক্ষা বিনামূল্য করা হলেও দরিদ্র মানুষজনও পরীক্ষা করতে আগ্রহী হবে। এতে সংক্রমণের প্রকৃত তথ্য উঠে আসবে।
কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে; বিশেষ করে সীমান্তবর্তী (রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী, নওগাঁ, এবং খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, বাগেরহাট) এলাকায় সংক্রমণের উচ্চহার দেখা যাচ্ছে। নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে জয়পুরহাটের করোনা পরিস্থিতি।
মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ অসীম কুমার নাথ বলেন, সংক্রমণ মোকাবেলায় রোগীকে শনাক্ত করা জরুরী। পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীকে শনাক্ত করে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। চিকিৎসার আওতায় আনলে তার সংক্রমণ ছড়াতে পারবে না। রোগী শনাক্ত না হলে তার নিজের অজান্তেই নিজের পরিবার ও বাইরের মানুষকে তিনি সংক্রমিত করতে পারেন।
‘করোনা পরিস্থিতি বোঝার জন্য কতজন শনাক্ত হয়েছে তা না দেখে পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার কেমন হয় তা দেখি’ মন্তব্য করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ জাহিদুর রহমান বলেন, গ্রামের মানুষের অসচেতনতা, করোনা নিয়ে কুসংস্কার এবং একেবারে গুরুতর না হলে তারা পরীক্ষা করাতে যান না।
গত বছরের মার্চে দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকে সরকারী হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল। তবে, পরবর্তীতে ২৯ জুন ‘অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা এড়াতে ও অধিকতর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতের জন্য’ সরকার করোনা পরীক্ষার জন্য মূল্য নির্ধারণ করে দেয়।
পরে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে সরকার মূল্য কমিয়ে আনে। বর্তমানে সরকারী বুথে কোভিড পরীক্ষার জন্য ১০০ টাকা করে নেয়া হয়। বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহের বিষয় থাকলে খরচ হয় ৩০০ টাকা। দুটি ক্ষেত্রেই সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে।
Leave a Reply