
মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। রয়েছে তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কাও। এ মহামারীর মধ্যেই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন। চলতি বছরের চেয়ে ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বেশি বাজেট প্রস্তাব করেছেন। রাজস্ব আহরণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের সমান রাখা হয়েছে। তবে রাজস্ব আহরণের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে ২৯ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনায় আমদানি-রপ্তানির গতি শ্লথ, দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসাবাণিজ্যে নেই গতি। মানুষের আয় কমে গেছে। বিভিন্ন খাতে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে করপোরেট করে বড় ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরে কালো টাকার ঢাকাও সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। আগামী অর্থবছরের বাজেটে সেটি সীমিত করা হয়েছে। ফলে এনবিআরের পক্ষে লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে। সব মিলিয়ে অর্থবছরে পুরো সময়ই রাজস্ব আহরণে চাপে থাকবে। আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করতে হবে। করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে এ লক্ষ্যমাত্রা অনেকটা অসম্ভবই।
অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাস্তবতার আলোকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন। চলতি অর্থবছরে বাকি দুই মাসে এক লাখ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করতে হবে, যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।তবে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দক্ষতা বাড়াতে হবে।
হিসাব অনুসারে ১ জুলাই থেকে এনবিআরকে প্রতিদিন ৯০৪ কোটি ১০ লাখ টাকা আহরণ করতে হবে। তবে রাজস্ব আহরণের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ব্যাপারে যে ধরনের পরিকল্পনা থাকার কথা তা উল্লেখ করেননি অর্থমন্ত্রী; উল্টো দিয়েছেন কর ছাড়।
রাজস্ব আহরণে তিন খাতেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। মধ্যবিত্তদের ওপর চাপটা থাকবে বেশি। তবে এ চাপ এনবিআরের জন্যও কম নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংস্কার ছাড়াই বিপুল রাজস্ব আদায় বরাবরের মতো এবারও চাপে থাকতে হবে এনবিআরকে। এ ছাড়া বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আহরণের জন্য যে ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন, নীতি সংস্কার এবং অন্যান্য সক্ষমতা- অনেক বেশি অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করেন তারা। ভ্যাট আইন চালুর পরও সম্পূরক শুল্ক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের কথা ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। ফলে ভ্যাটের পুরো চাপ জনগণের ওপর আসবে।
গত বৃস্পতিবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৯ হাজার কোটি টাকা বেশি।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি আদায় করা এনবিআরের জন্য মহাচাপের। গত কয়েক অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরকে একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। কিন্তু তার কোনো নির্দেশনা থাকে না। জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে ভ্যাটকে রাজস্ব আহরণের প্রধান খাত হিসেবে ধরা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট থেকেই আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা, যা চলতি সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা বেশি। আর আয়কর ১ লাখ ৪ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ হাজার ২ কোটি টাকা বেশি।
সম্পূরক শুল্কের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৪ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৬ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা বেশি। আমদানি শুল্কের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৭৫৩ কোটি টাকা বেশি। রপ্তানি শুল্ক থেকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৬ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছর সংশোধিত বাজেটের থেকে ২ কোটি টাকা বেশি। আবগারি শুল্কের লক্ষ্যমাত্রা ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরে এ খাতের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য কর বাবদ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা, চলতি বছর এ খাতের লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ৫৩০কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, চলতি অর্থবছরের পুরো সময়েই করোনার কারণে ব্যবসাবাণিজ্যের গতি মন্থর ছিল। বৈশি^ক মহামারী মোকাবিলা করে আমরা অর্থনীতি এবং জিডিপির গতি ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। আগামী অর্থবছরেও দেশের অর্থনীতি একেবারে স্বাভাবিক হবে না বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। বৈশি^ক করোনা মহামারী, বিশ^ বাণিজ্যে মন্দা ও অস্থিতিশীল বিশ^বাণিজ্যকে বিবেচনায় নিয়েই আগামী রাজস্বনীতি প্রণয়ন করেছি। ব্যবসাবাণিজ্যে কোভিডের প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে রাজস্ব আহরণের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনীতির গতি বৃদ্ধির বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবারের রাজস্ব বাজেটে। আগামী অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগসুবিধা বাড়ানোর কাজ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি চলতি অর্থবছরের মতোই প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ, সরঞ্জাম ও রসদ সরবরাহ, দক্ষতা বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি যদি রেভিনিউয়ের হার আস্তে আস্তে কমাই, তা হলে কালেকশন বাড়বে। আমরা যে কর কমালাম, আমরা বিশ্বাস করি ‘উই উইল বি উইনার’। করের হার কমানো হয়েছে, আশা করি আমাদের রেভিনিউ কালেকশন আরও বাড়বে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৯.৬ শতাংশ। বলা হচ্ছে, রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণ করা হবে। ব্যয় ঠিক করে আয়ের চিন্তাধারা থেকে এনবিআরের ওপর রাজস্ব আদায়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। যা আসলে অর্জন করা সম্ভব হয় না।
Leave a Reply