জীবন-জীবিকার বাজেটে বিশাল ঘাটতি

গতবারের মতো এবারো করোনাভাইরাস মহামারির সংকটে টিকে থাকতে ও অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে আরও বড় আশার বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। করোনার মধ্যে সরকারের এটি দ্বিতীয় বাজেট। ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে গতকাল বিকালে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। বিশাল ঘাটতির এই বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় মেটাতে অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করতে হবে। করোনাকালের এই বাজেট বাস্তবায়নকেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন করতে সুশাসন নিশ্চিত ও রাজস্ব আদায় কৌশল সহজ করতে হবে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলছে, করোনাকালে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বাজেটে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকার কথা থাকলেও এমন কিছু নেই। বিরোধী বিএনপির নেতারা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, বাজেটে সুশাসন এবং জবাবদিহিতার বিষয়টি অনুপস্থিত।

প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ৭৬ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি দেখানো হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৬.২ শতাংশ। চলতি বাজেটে এ ঘাটতি ছিল ৬.০ শতাংশ।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা আগের মতোই ৩ লাখ টাকা রাখা হয়েছে। এদিকে ভাইরাসের প্রকোপ কমাতে টিকাদানে অধিক গুরুত্ব দিয়ে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে বাজেটে এবারও ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এই অঙ্ক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের প্রায় ১১ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৩ লাখ ৩০ হাজার ৭৮ কোটি টাকা আদায়ের আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত থেকে কর আসবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। কর ব্যতীত আয় হবে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বৈদেশিক অনুদান থেকে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছেন।

অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ৭৬ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরো ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে বাজেটে।

অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, তার নতুন বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলে মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশের মধ্যে আটকে রেখেই ৭.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব হবে।

এবারের ৬ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ১৪ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এরই মধ্যে এডিপি অনুমোদন করা হয়েছে। এবার পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত অনুন্নয়ন বাজেটের চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ৬৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধেই যাবে, যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় ১৯ শতাংশের বেশি।

বৃহস্পতিবার আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কর্মসূচির আওতা আরো বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ‘জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর’ বাজেটে প্রথমবারের মতো সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে এক লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রস্তাবিত বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের বরাদ্দের তুলনায় ১১ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা বেশি।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু পণ্যের করহার কমানো হয়েছে। এতে এসব পণ্যের দাম কমতে পারে। উপকরণ আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দেয়া হয়েছে। এতে মুরগি, মাছ ও গবাদিপশুর খাবারের দাম কমানোর সুযোগ তৈরি হবে। দেশে এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনে কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দেয়া হয়েছে।

বাজেটে কিছু পণ্যের শুল্ক-করহার বাড়ানো হয়েছে। এতে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে। বাজেটে মুঠোফোন (ফিচার ফোন) আমদানিতে আমদানি শুল্ক ১০ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে বিদেশি মুঠোফোনের দাম আরো বাড়তে পারে।

মাংস আমদানিতে শুল্কহার বাড়ানো হয়েছে। বসানো হয়েছে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট। আবার ন্যূনতম শুল্কায়ন মূল্যের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বিদেশি মাংসের দাম বাড়বে। চাষিদের সুরক্ষা দিতে গাজর, ক্যাপসিকাম, কাঁচামরিচ, টমেটো ও কমলা আমদানিতে ন্যূনতম শুল্কায়ন মূল্য আরোপের কথা বলা হয়েছে। এতে এসব পণ্য আমদানিতে কম দাম দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দেয়া যাবে না।

দাম বাড়তে পারে। গাজরের ওপর ভ্যাটও আরোপ করা হয়েছে। শিল্প লবণের ওপর কর বাড়ানো হয়েছে। এতদিন শিল্প লবণের নামে ভোজ্য লবণ আমদানি হতো। এখন দুই লবণের করহারের সমন্বয় করা হয়েছে। সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে দাম বাড়বে।

বিস্কুট ও সমজাতীয় সুগার কনফেকশনারির ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে দাম অনেকটাই বাড়তে পারে।

গতকাল বিকালে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। তার আগে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর ওই প্রস্তাবে সই করেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। সংক্রমণ এড়াতে এবারও স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়ির মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থায় সংক্ষিপ্ত সময়ে বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আজ সংবাদ সম্মেলনে আসবেন অর্থমন্ত্রী। করোনা সংক্রমণ ঝুঁকির কারণে এবার অর্থমন্ত্রীর এই সংবাদ সম্মেলন হবে জুম প্ল্যাটফরমে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.