পাট থেকে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির পথে বাংলাদেশ

পাটকে বলা হয় বাংলাদেশের সোনালী আঁশ। এই গাছের ভিতরে লুকিয়ে আছে কত না রহস্য। বাংলাদেশের প্রয়াত বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে গবেষকরা আবিষ্কার করেন পাটের জিন। বিজ্ঞানী মোবারক আহমেদ খান পাট থেকে পলিথিন আর ঢেউটিন তৈরি রাস্তা দেখিয়েছেন। আর এবার সেই পাট থেকেই দেশের গবেষকরা পথ দেখালেন জীবন বাঁচানো অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির। গত ২৭ মে ন্যাচার পাবলিশিং গ্রুপের ‘সাইন্টিফিক রিপোর্ট’ জার্নালে তাদের এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকদের এই দলটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) একাধিক অধ্যাপক, কিছু শিক্ষার্থী এবং বাংলাদেশ বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিলের (বিসিএসআইআর) সদস্য রয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খান, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম এবং জীন প্রকৌশল ও জৈব প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আফতাব উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল গবেষক পাট থেকে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির এই গবেষণায় অংশ নেন। গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে পাট নিয়ে গবেষণা করছেন হাসিনা খান। সেই পাটের জীবন রহস্য বের করতে গিয়ে তিনি এর বিভিন্ন অংশে নানা রকম অণুজীবের সন্ধান পান। অণুজীবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানার আগ্রহ থেকে একই বিভাগের অণুজীব বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিয়াজুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হয় নতুন গবেষণা। তাতে যুক্ত হন জিন প্রকৌশল জীব প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আফতাব উদ্দিন।

গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেন, পাটের তন্তুর খাঁজে খাঁজে ৫০টিরও বেশি অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়ায় বাস করে। এসব ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ‘স্টেফাইলো কক্কাস হোমিনিস’ নামের একটি ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। এটি নিজের শরীর থেকে এমন কিছু তৈরি করে যাতে আবার অন্য ব্যাকটেরিয়ারা মারা যায়। আর তাতেই বেরিয়ে আসে নতুন এই অ্যান্টিবায়োটিকের খোঁজ। যা বাঁচিয়ে দিতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিট্যান্স (যাদের দেহে অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করছে না) হওয়া অনেক রোগীর প্রাণ। ব্যাকটেরিয়া ও পাটের বৈজ্ঞানিক নামের সঙ্গে মিল রেখে নতুন এ এন্টিবায়োটিকের নাম দেয়া হয়েছে ‘হোমিকরসিন’। বেশ কিছু শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে এটি ভালো কাজ করছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানান তারা। এই অ্যান্টিবায়োটিকের ৫টি ভ্যারিয়েন্ট আছে। তার মধ্যে ২টি নিয়ে কাজ শেষ করেছেন গবেষকরা। বাকি ৩টি নিয়ে আরও কাজ চলছে বলেও জানান তারা।

গবেষক দলে ছিলেন ড. এম আফতাব উদ্দিন, শাম্মী আক্তার, মাহবুবা ফেরদৌস, বদরুল হায়দার, আল আমিন, এএইচএম শফিউল ইসলাম মোল্লা, ড. হাসিনা খান ও ড. মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম।

গত ২৭ মে ন্যাচার পাবলিশিং গ্রুপের ‘সাইন্টিফিক রিপোর্ট’ জার্নালে তাদের এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

বৈজ্ঞানিক দলের জ্যেষ্ঠ সদস্য এবং ঢাবির প্রাণরসায়ন ও আণবিক জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসিনা খান বলেন, পাটের বীজ থেকে আমরা যে অণুজীবটি পেয়েছি এই অণুজীব একটি নতুন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করে। এই নতুন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি এই একটি অ্যান্টিবায়োটিকের পাঁচটি ভ্যারিয়েন্ট আছে। সেটিই আমাদের কাছে খুব আশ্চর্যজনক মনে হলো। দুটি ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে আমরা প্রকাশনা করেছি, আরও তিনটি আছে যেটি নিয়ে আমরা কাজ করছি।

তিনি আরও বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক মূলত দুই ধরনের হয়। একটি হল ব্রড স্পেক্ট্রাম যেটা সব ধরনের অণুজীবে কাজ করে। আরেকটা হচ্ছে গ্রাম পজিটিভ এবং নেগেটিভ। আমাদের অ্যান্টিবায়োটিক এই ক্যাটেগরির ক্ষেত্রে কাজ করবে। আমাদের এই অ্যান্টিবায়োটিক ব্রড স্পেক্ট্রাম না। এখন দেখা যাচ্ছে সেটাই সবচেয়ে ভালো অ্যান্টিবায়োটিক। কারণ ব্রড স্পেক্ট্রামকে এতদিন খুব ভালো মনে করা হয়েছে, একটি অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে অনেকগুলো জীবাণুর বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু তাতে সমস্যা হয় তখন জখন তার বিপক্ষে অণুজীবটি প্রতিরোধ দাঁড় করিয়ে ফেলে। তখন অ্যান্টিবায়োটিকটি আর কাজ করে না।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.